পূর্ণেন্দু সিংহ, বাঁকুড়া : পুজো আসতে বাকি আর হাতে গোনা কয়েকটা দিন। চারিদিকেই একটা পুজো-পুজো ভাব চলে এসেছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে উৎসবের আমেজের পরিবর্তে বিষন্নতার ছায়ায় আচ্ছন্ন বাঁকুড়ার ঢাকিদের মনে। ভ্যাকসিন না নেওয়া হলে তাঁরা কোথাও ঢাক বাজাতে যেতে পারবেন না, কবে ভ্যাকসিন হবে সেই দুশ্চিন্তাতেই ছিলেন বাঁকুড়ার দু নম্বর ব্লকের প্রতাপপুরের ১০০টি ঢাকি পরিবার। তবে শেষমেশ স্বস্তির হাসি তাদের মুখে।


পুজো মানেই ঢাকের তালে ধুনুচি নাচ। দুর্গাপুজোর সঙ্গে ঢাকের বাদ্যির সম্পর্ক যেন অপরিহার্য। তাই প্রতিবছর পুজোর বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই বিভিন্ন ঢাকি পাড়ায় শুরু হয়ে যেত ঢাকের মহড়া। তুমুল ব্যস্ততায় দিন কাটত ঢাকিদের। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বায়না আসত। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে বদলে গিয়েছে সেই সব দিন। এখনও পর্যন্ত রাজ্যে সমস্ত মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়ার কাজ সম্পন্ন করা যায়নি। ভ্যাকসিন নেওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছিলেন বাঁকুড়ার দু'নম্বর ব্লকের প্রতারপুরের একশোরও বেশি ঢাকি পরিবার। অবশেষে ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য আধিকারিককে লিখিত আবেদন জানানোয় সুরাহা হল তাঁদের।




প্রতিবছরই পুজোর সময় মহারাষ্ট্র, দিল্লি, গুজরাট, কলকাতা, ঝাড়খণ্ড, আসানসোলের মতো জায়গায় ঢাক বাজানোর বরাত পান প্রতাপপুরের ঢাকিরা। গতবছর অতিমারির কারণে তাঁরা কোথাও ঢাক বাজাতে যেতে পারেননি তারা। গতবছরের পুজোটা তাঁদের বাড়িতেই কেটেছে। এইবছর তাঁরা ভিন রাজ্য এবং জেলা থেকে ঢাক বাজানোর বরাত পেয়েছেন। কিন্তু তাঁদের রোজগারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনা অতিমারি। কিন্তু ভ্যাকসিন নেওয়া না হওয়ায় তাঁরা কোথাও যেতে পারছিলেন না। পাশাপাশি কবে ভ্যাকসিন নেওয়া হবে, তারও কোনও সঠিক উত্তর পাচ্ছিলেন না। ফলে, চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটছিল তাঁদের। 


এই সময়েই বাঁকুড়া দু নম্বর ব্লকের কাঞ্চনপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য আধিকারিক দেবজ্যোতি গোস্বামীকে ঢাকিরা ভ্যাকসিনের জন্য লিখিত আবেদন জানান। ভ্যাকসিন নেওয়ার আবেদনের ভিত্তিতে আজ প্রতাপপুর গ্রামে জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরের পক্ষ থেকে এবং কাঞ্চনপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্যোগে ভ্যাকসিনের ক্যাম্প হয়। যেখানে ইতিমধ্যেই ১০০জন ঢাকি ভ্যাকসিন নেন। ফেলু বাদ্যকর নামে এক ঢাকি বলেন, 'কাশি, বেনারস থেকে ঢাক বাজানোর ডাক এসেছে। কিন্তু ভ্যাকসিন নেওয়া হয়নি বলে বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে যাব। তখনই আমরা কাঞ্চনপুরের ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আর আজ আমাদের গ্রামে ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। এবার মনে জোর পেলাম। এই পুজোর সময়ে ঢাক বাজানোর বরাত পেলে দুটো টাকা রোজগার হয়। কিন্তু করোনার কারণে গতবছর থেকে বাড়িতে রয়েছি। এবছর তাও কয়েকটা বরাত পেয়েছি। কিন্তু তারমধ্যেও ভ্যাকসিনের চিন্তায় বুঝতে পারছিলাম না কী হবে। এটাই আমাদের জীবিকা। তবে, আর চিন্তা নেই।'


আর এক ঢাকি বিশ্বনাথ মল্লিক বলছেন, 'করোনা আর লকডাউনের মধ্যে খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছিলাম। ট্রেনে বাসে কোথাও গেলেই ভ্যাকসিন নেওয়া আছে কিনা জিজ্ঞাসা করত। এইবছর পুজোয় ঢাক বাজানোর বরাত পেয়েছি বাইরে থেকে। কিন্তু ভ্যাকসিন না নেওয়া থাকলে তো কোথাও যেতে পারছিলাম না। তাই আমরা টিকার আবেদন জানাই। এবার আমরা ঢাক বাজিয়ে পরিবারের হাতে দুটো পয়সা তুলে দিতে পারব।' এই প্রসঙ্গে কাঞ্চনপুরের ব্লক প্রাথমিক আধিকারিক দেবজ্যোতি গোস্বামী বলেন, 'ভ্যাকসিনের সমস্যা নিয়ে আমার কাছে কয়েকজন ঢাকি এসেছিলেন। যখনই রাজ্যে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে, আমরাও ভাবছিলাম ঢাকিদের টিকা দেওয়ার কথা। কারণ, টিকাকরণ না হলে তো ওরা বাইরে কোথাও ঢাক বাজাতে যেতে পারবে না। এটা ওদের রুটিরুজির বিষয়। তাই আজ অন্তত ১০০জন ঢাকিকে ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে।'