সন্দীপ সরকার ও আবীর দত্ত : রামপুরহাটকাণ্ডে পুলিশের পর দমকলের ভূমিকা নিয়েও তৈরি হয়েছে রহস্য। গ্রামবাসীর দাবি, সেই রাতে সাড়ে ন’টা নাগাদ সোনা শেখের বাড়িতে আগুন লাগে। অথচ, রাত দশটা পঁচিশে গ্রামে পৌঁছনো দমকলের দাবি, তারা সোনা শেখের বাড়িতে আগুন জ্বলতে দেখেনি। এদিকে, সেই সোনা শেখের বাড়ি থেকেই সাতজনের দগ্ধ মৃতদেহ উদ্ধার হয়।
পুলিশের ভূমিকা আগেই প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এবার রহস্য তৈরি হল দমকলের ভূমিকা নিয়েও। এই ঘটনায় ধ্রুবজ্যোতি দত্ত নামে রামপুরহাট থানার এক সাব ইন্সপেক্টরের স্বতঃপ্রণোদিত অভিযোগের ভিত্তিতে FIR করে পুলিশ। যেখানে বলা হয়েছে, ২১ মার্চ রাত সাড়ে আটটা নাগাদ তৃণমূলের পঞ্চায়েত উপপ্রধান ভাদু শেখ খুন হন। রাত আটটা পঞ্চাশে পুলিশ সেখানে পৌঁছে যায়। ৯টা ৩৫মিনিটে রামপুরহাট থানার ডিউটি অফিসার রমেশ সাহা জানান, বগটুই গ্রামে কয়েকটা বাড়িতে আগুন লেগেছে। আধঘণ্টা পর, রাত দশটা পাঁচে ভাদু শেখের খুনের জায়গা থেকে পুলিশ বগটুই গ্রামে পৌঁছোয়।
ভাদু শেখের খুনের জায়গা থেকে বগটুই গ্রামের দূরত্ব এক কিলোমিটার। এইটুকু দূরত্ব যেতে কতটা সময় লাগতে পারে ? এখানেই প্রশ্ন উঠছে, যে রাস্তা পেরোতে তিন মিনিটের কম সময় লাগার কথা, আগুন লাগার খবর পেয়েও, সেখানে যেতে পুলিশের আধঘণ্টা লাগল কেন?
পুলিশের এফআইআর। যার ভিত্তিতে সিবিআই তদন্ত করছে। পুলিশের এফআইআরের বয়ান। ফাঁকফোকড়ের জায়গা। দমকল কী বলছে ? কী ঘটেছিল সেই রাতে ? এফআইআরে এসআই ধ্রুবজ্যোতি দত্ত বলছেন, রাত সাড়ে আটটায় ভাদু শেখকে লক্ষ্য করে বোমাবাজি হয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তিনি ঘটনাস্থলে যান। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন। ৯.৩৫’এ রামপুরহাট থানার ডিউটি অফিসার রমেশ সাহা ফোন করেন। বগটুইতে কিছু বাড়িতে আগুন লেগেছে । যেতে নির্দেশ। ১০.০৫’এ বগটুই পৌঁছয় পুলিশ। ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কে বগটুই মোড় থেকে বগটুই গ্রামের দূরত্ব এক কিলোমিটার। যেতে আধঘণ্টা সময় লাগল ? দিনের বেলায় ব্যস্ত সময়ে যেটা ৩ মিনিটের কম লাগার কথা, সেটা পুলিশের যেতে লাগল ৩০ মিনিট। এফআইআরে বলছে, আটটা বাড়িতে আগুন জ্বলছে। খড়ের গাদা জ্বলছে। বিধ্বংসী আগুন। বাড়ছে। ডিউটি অফিসারকে কল করে বললাম, দমকলকে খবর দিতে। ১০.২৫’এ দু’টো ইঞ্জিন এসে নেভানোর কাজ শুরু করল। এখানে প্রশ্ন - ডিউটি অফিসার স্পটে যেতে বলছেন, তখন দমকলকে ডাকেননি। দমকলকে বলতে পারত। সেটা করা হয়নি।
ওই রাতে, ধ্রুবজ্যোতি দত্ত ডিউটি অফিসারকে দমকলকে ডাকার কথা বললেও, থানা থেকে ফোন যায়নি। দমকলের রেকর্ড বলছে ১০.১৩-তে ফোন এসেছিল। গ্রামের এক বাসিন্দার। ১০.২৫’এ পৌঁছোয় তারা। পুলিশ ফোন করেনি, দমকলকে ফোন করেছিলেন, একজন। তার ফোন পেয়ে দমকল বেরোয়। ১০.২৫’এ পৌঁছোয়। এফআইআরে বলছে, ১০.২৫’এ দমকল পৌঁছায়। চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পৌঁছানো হয়। রাত দু’টোয় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। দমকল এলাকা থেকে বেরিয়ে যায়। পুলিশ বলছে, মাঠের ধারে আরেকটা বাড়িতে আগুন জ্বলছে। ফটিক শেখের বাড়ি। নাজিমা বিবির বাড়ি থেকে ফটিক শেখের বাড়ি ২০০ মিটার দূরে। এই দু’টো স্পটের মাঝে সোনা শেখের বাড়ি।
বগটুই গ্রামের মোড়ে পৌঁছায় দমকল বাহিনী। নাজিমা বিবি এবং তাঁর আশপাশের বাড়িতে আগুন জ্বলছে। সেখানে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। দমকলের দাবি - তারা ওই রাতে বানী শেখ, সোনা শেখের বাড়িতে আগুন জ্বলতে দেখেনি। ওই বাড়িতে ওই রাতে জল দেয়নি। ওই বাড়িতে আগুন জ্বলছিল না, ধোঁয়া ছিল না।
নাজিমার থেকে ফটিকের বাড়িতে যেতে বাঁ দিকে পড়ে সোনা শেখের বাড়ি। ফেরার সময়ও নাকি দেখেনি। রাতে ফিরে আসে। পরদিন সকাল সাতটা দশে আবার ডাকা হয়। ফটিক শেখের বাড়িতে আগুন নেভাতে যায়। দমকলের বক্তব্য অনুযায়ী, ওই দিন সকালেও তারা সোনা শেখের বাড়িতে আগুন লেগেছে জানত না।
সকাল ন’টা নাগাদ পুলিশ ডেকে বলে, কয়েকটা বাড়িতে সার্চ করতে হবে। তখন প্রথম সোনা শেখের, বানি শেখের বাড়িতে ঢোকে। তখন ঘর থেকে দেহ উদ্ধার হয়।
নাজিমা বিবির স্বামী বলেন, আগুন লাগার অনেক পরে দমকল এসেছিল। দমকল ও পুলিশকে ওরা কাজ করতে দেয়নি। দমকল তো কাজই করতে পারেনি। দমকল জল দিলে এতগুলো মানুষ মরত না। এখন প্রশ্ন উঠছে, দমকল সত্যি বলছে, না কাউকে আড়াল করছে ?