বিজেন্দ্র সিংহ ও রঞ্জিত হালদার, নয়াদিল্লি : 'মালদার আদিনা মসজিদ একসময় আদিনাথ মন্দির ছিল। সেখানে হিন্দু ধর্মের স্থাপত্যও আছে। সেগুলিকে সংরক্ষণ করা উচিত।' রাজ্যসভায় আর্জি জানালেন শমীক ভট্টাচার্য। মানুষের জন্য কোনও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পেরে, নজর ঘোরানোর চেষ্টা। পাল্টা কটাক্ষ করলেন তৃণমূল সাংসদ দোলা সেন।
মুর্শিদাবাদে হুমায়ুন কবীরের 'বাবরি মসজিদ'-এর শিলান্য়াস নিয়ে রাজ্য় রাজনীতিতে টানাপোড়েন তুঙ্গে। এরইমধ্য়ে বিধানসভা ভোটের ঠিক মুখে জন্ম নিয়েছে আরেক বিতর্ক! শুক্রবার রাজ্যসভায় মালদার আদিনা মসজিদের প্রসঙ্গ তোলেন বিজেপি সাংসদ ও দলের রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য। তাঁর দাবি, একসময়ের আদিনাথ মন্দিরই আজকের আদিনা মসজিদ। তাই সেখানে মন্দির পুনরুদ্ধার করা উচিত!
বিজেপির রাজ্য সভাপতি ও রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য বলেন, "কোনও মন্দির-মসজিদের লড়াই নয়। কোনও হিন্দু-মুসলমানের বিভাজনের বিষয় নয়। কিন্তু, কী ঘটেছিল ? মালদা জেলার পাণ্ডুয়ায় ব্রিটিশদের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন জিতু সান্থাল। ওঁর লক্ষ্য এটাই ছিল যে, সন্ন্যাসীর দলের সাহায্যে আদিনাথ মন্দির পুনরুদ্ধার করবেন। আর আজ কী হচ্ছে ! এটা ঐতিহাসিক তথ্য, প্রখ্যাত ওরিয়েন্টালিস্ট (প্রাচ্যবিদ) জে ডি বিগলার, মালদার কালেক্টর জে এইচ রবিন শাহ ১৮৬৫ থেকে ১৮৬৭ সালে তাঁরা...বিভিন্ন ধরনের প্রমাণ নথিভুক্ত করেছিলেন, যে তথ্য দাবি করে যে সেখানে হিন্দু মন্দির ছিল।"
পাল্টা তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ দোলা সেন বলেন, "মানুষের চোখ ঘোরাবার জন্য অকারণ মন্দির-মসজিদ ইস্যু করবেন না।"
রাজ্য়সভায় জিরো আওয়ারে বিষয়টি তুলে ধরার জন্য রাজ্যসভার সেক্রেটারি জেনারেলকে যে চিঠি পাঠিয়েছেন শমীক ভট্টাচার্য, সেখানে তিনি লিখেছেন, আমি মালদার পাণ্ডুয়ায় ঐতিহ্যবাহী স্থান নিয়ে জরুরিভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। যেটি সাধারণত আদিনা মসজিদ হিসেবে পরিচিত। ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, এখানে প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরের উপাদান রয়েছে। একই সঙ্গে তিনি দাবি করেছেন, আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অধীনে থাকা স্মৃতিসৌধ কয়েক দশক ধরে আংশিক অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটেই কেন্দ্রীয় সরকারে কাছে কিছু দাবিদাওয়া রেখেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি। সেই সঙ্গে হুমাযুন কবীরের প্রস্তাবিত 'বাবরি মসজিদে'রও বিরোধিতা করেছেন তিনি। শমীক ভট্টাচার্য বক্তব্য রাখার সময় তাঁর বিরোধিতা করেন তৃণমূল সাংসদরা।
শমীক ভট্টাচার্য বলেন, "এই ভাবে কতদিন চলতে পারে ! আমরা ইতিহাসকে মুছে দিতে পারি না। আমরা আমাদের রীতি-নীতি, সংস্কারকে ত্যাগ করতে পারি না। কিন্তু, এটাই পশ্চিমবঙ্গে হয়ে আসছে। এখন সেখানে 'বাবরি মসজিদ' তৈরি করার তোড়জোড় চলছে। আর আদিনা মসজিদ নয়, ওটা আদিনাথ মন্দির। এর ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে। ASI-এর নথি রয়েছে। আর সেটা (মন্দির পুনরুদ্ধার) করতে দেওয়া উচিত। সেটির উপর গবেষণা হওয়া উচিত। সমস্ত হিন্দু সংস্কৃতির প্রমাণ রয়েছে। পদ্মফুল, জনিপীঠ, শিবলিঙ্গ, লক্ষ্মী ঠাকুরের হাত,সব মুছে ফেলা হচ্ছে। সেটা বন্ধ করা উচিত। সরকারের কাছে আমাদের আর্জি, সেটাকে রক্ষা করা উচিত।"
সম্প্রতি মালদার আদিনা মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে, বিতর্কের মুখে পড়েন বহরমপুরের তৃণমূল সাংসদ ইউসুফ পাঠান। ছবি পোস্ট করে তিনি লিখেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের মালদার আদিনা মসজিদ একটি ঐতিহাসিক মসজিদ। যা ১৪ শতকে ইলিয়াস শাহি রাজবংশের দ্বিতীয় শাসক সুলতান সিকন্দর শাহ তৈরি করেছিলেন। ১৩৭৩ থেকে ১৩৭৫ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়েছিল। এটি সেই সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের বৃহত্তম মসজিদ ছিল, যা ওই অঞ্চলের স্থাপত্যের মহিমা প্রদর্শন করে।
এদিন তৃণমূল সাংসদের এই পোস্ট নিয়েও সরব হন বিজেপির রাজ্য সভাপতি। শমীক ভট্টাচার্য বলেন, "আমি কোনও মন্দির-মসজিদের লড়াইয়ের কথা বলিনি। এই লড়াই হিন্দু-মুসলমানের নয়। এই লড়াই ভারতীয় ইতিহাসের পুনরুদ্ধারের। শিকন্দর শাহ একজন লুটেরা। তিনি গৌড় সাম্রাজ্যের সমস্ত স্থাপত্য ধ্বংস করেছিলেন, এবং সেখানেই থেমে থাকেননি। আদিনাথের মন্দিরকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে, আজ সেখানে আদিনা মসজিদের নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটাকে তো রক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে। আমার দাবি ভারত সরকারের কাছে যে, ASI ওখানে আরও বেশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুক। সাম্প্রতিককালে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ ইউসুফ পাঠান তিনি আদিনা মসজিদে গিয়েছিলেন এবং আদিনা মসজিদের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি যে ছবি তিনি সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন, তাতেও দেখা যাচ্ছে, যে তাঁর পিছনে হিন্দু স্থাপত্য বিদ্যমান।"
পাল্টা দোলা সেন বলেন, "মোদিবাবুরা না খেতে দিতে পারছেন, না পড়তে দিতে পারছেন, যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ২ কোটি চাকরি, ২ পয়সার চাকরি দিতে পারেননি। তো কিছু তো পয়েন্ট চাই মানুষের চোখ ঘোরাবার জন্য। মানুষ তো চেপে ধরবে। সেই জন্য চোখ ঘোরাবার জন্য মন্দির-মসজিদ এই সব নন-ইস্যুকে নিয়ে আসছেন। কোথায় আদিনা মসজিদ ছিল, আদিনাথ মন্দির। এইসব হাবিজাবি অ্যাজেন্ডা করছেন। সেই জন্য আমরা প্রতিবাদ করছিলাম। যে আগে মানুষকে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংবিধান অনুযায়ী যেটা আমার মৌলিক অধিকার, সেটা মানুষকে দিন।"
একদিকে শনিবার যখন মুর্শিদাবাদের বুকে বাবরি মসজিদের শিলান্য়াস...তখন রবিবার ব্রিগেডে ৫ লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠের প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে।