কলকাতা: ১৮ বছরের সম্পর্ক। বিয়ে হয়েছিল কয়েক বছর আগে। সম্প্রতি কোল আলো করে সন্তানও এসেছিল। কিন্তু তার মধ্যেই ডেঙ্গির (Dengue) করাল থাবা অন্ধকারে ডুবিয়ে দিল বসু ও নন্দী পরিবারকে।
কয়েকদিন আগে ডেঙ্গি আক্রান্ত (Dengue Infection) হয়েছিলেন সদ্য প্রসূতি পায়েল বসু নন্দী। গত ২৬ অগাস্ট পুত্রসন্তান প্রসব করেন তিনি। সন্তান জন্মের তিনদিনের মাথায় তাঁর ডেঙ্গি ধরা পড়ে। একাধিক হাসপাতাল ঘুরে পিয়ারলেস হাসপাতালে (Peerles Hospital) ভর্তি করা হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। সেখানেই মারা যান পেশায় শিক্ষিকা পায়েল। কিন্তু সেই কয়েকটি দিন কতটা দুর্বিষহ অবস্থা হয়েছিল ওই পরিবারের?
ঘণ্টাখানেক সঙ্গে সুমন অনুষ্ঠানে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শোনান ডেঙ্গিতে মৃত (Dengue Death) প্রসূতি পায়েল নন্দী বসুর স্বামী রাকেশ বসু। প্রতি পদে যে অসহনীয় অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর, সেটাই জানান তিনি। অভিজ্ঞতার কথা শোনাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন রাকেশ।
তিনি জানান, ২৬ অগাস্ট গর্ভধারণের (Pregnancy) ৩৭ সপ্তাহ কমপ্লিট হয় তাঁর স্ত্রীর। যে ডাক্তার দেখছিলেন তাঁর পরামর্শে রামকৃষ্ণ সারদা মিশন মাতৃভবনে ভর্তি করাই। ২৬ আগস্ট তারিখ সকালে নিয়ে যাওয়া হয়। তার পরপরই ওটি হয়ে যায়। আমার স্ত্রী বলল ও কনফিডেন্ট। ওই দিনই বিকেলে পুত্র সন্তান হয়। রাকেশ জানাচ্ছেন, 'ডাক্তার বলেছিল সব ঠিক আছে। ২৬, ২৭, ২৮ প্রতিদিন কথা বলেছি। ডাক্তাররা বলছেন আপনার ওয়াইফ রিকভার করছে। আমি ২৮ তারিখ গেলাম। আমায় বলল বাচ্চাটাকে ধর, আমার কাঁপুনি আসছে। আমি দেখলাম ডাক্তার নেই, যিনি নার্স তিনি ভাল ছিলেন, এসে কম্বল চাপা দিল। ডাক্তার বলল এখন এমন হয়। আমি শুনে আশ্বস্ত হয়েছিলাম।' রাকেশ জানাচ্ছেন, এরপরেই ৩০ আগস্ট সকালে হাসপাতাল (Hospital) থেকে ফোন করা হয়। জানানো হয়, এমারজেন্সি আছে। তা শুনেই কোনওমতে হাসপাতালে যান রাকেশ। তিনি বলছেন, 'গিয়ে দেখি পায়েলের নামে ডিসচার্জ সার্টিফিকেট লিখছে, তখন আমায় জানাল ওর ডেঙ্গি হয়েছে। তখন হাসপাতাল বলছে এখানে ডেঙ্গির সুবিধা নেই, এখান থেকে নিয়ে যান। নয়তো আলাদা জায়গায় রেখে দেব। নানা কাগজে সই করাচ্ছে। আমার সঙ্গে কুকুরের মতো ব্যবহার করছিল তখন।'
https://bengali.abplive.com/tv-show/ghantakhanek-sange-suman/gkss-part-1-22-09-23-dengue-death-roll-across-the-state-4-dead-in-a-day-1011241
এরপরেও চলেছে ভোগান্তি। নানা হাসপাতালে ঘুরেও বেড পাননি বলে অভিযোগ রাকেশের। একাধিক সরকারি হাসপাতালে গিয়েও জায়গা পাননি। কোথাও কোনও সুবিধা পাননি বলে অভিযোগ। তারপর? রাকেশ জানাচ্ছেন, 'তারপর আইরিশ হাসপাতালে নিয়ে যাই, ওখানে ICU-তে ভর্তি করাই। ৩০ তারিখ সন্ধেবেলা আইরিশে ভর্তি করাই। পরদিন সকালে গিয়ে দেখি আমার স্ত্রীয়ের অবস্থা আরও অবনতি হয়েছে। সামনে জলের বোতলে জল নেই, আমি জিজ্ঞেস করলাম, জল কোথায়? তখন পায়েল আমায় বলল অনেকক্ষণ ধরে চাইলেও জল দেয়নি। তারপর ১২টা নাগাদ ডাক্তারকে বললাম। সব শুনে ওখানে এক নার্স ছিল তিনি বললেন, চিকিৎসা পছন্দ না হলে বের করে নিয়ে যেতে। আমার হেল্থ ইন্সিউরেন্স (Health Insurance) ছিল। আইরিশ থেকে আমায় বলল এখানে ইন্সিউরেন্স কাজ করবে না। আমি তখন ডিসচার্জ করিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ওই অবস্থায় ওকে ডিসচার্জ করতে চার ঘণ্টা নিল। ১৬ ঘণ্টাও থাকেনি ১৬ হাজার টাকা বিল করেছিল।'
এরপরে শুরু হয় বেড খোঁজা। তখন বন্ধুদের সাহায্যে কোনওমতে বাইপাসের ধারে পিয়ারলেস হাসপাতালে বেড মেলে। ৩১ তারিখ সন্ধেবেলা পিয়ারলেস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ডাক্তার ICU-তে ভর্তি কার হয় পায়েলকে। এরপর? রাকেশ বললেন, 'পরদিন গিয়েছি, আমার শাশুড়িও গিয়েছেন। তখন বলল পেটের খুব সমস্যা হচ্ছে। আমি ডাক্তারকে বললাম, ডাক্তার শুনে বলল চিন্তার কিছু নেই। এগুলি ডেঙ্গির উপসর্গ। আমি শুনে চলে আসলাম। পায়েলের সঙ্গে কথাও বললাম, ওকে বললাম চারটের সময় আসছি। আমি তখন বুঝিনি ওর সঙ্গে ওটাই আমার শেষ কথা হবে।' কথা বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন রাকেশ।
সেদিনই ওখান থেকে মাতৃভবনে গিয়েছিলেন রাকেশ, ওখানেই ভর্তি ছিল তাঁর সদ্যোজাত পুত্রসন্তান। তিনি বললেন, 'আমি তখন মাতৃভবনে গিয়েছি আমার ছেলেকে দেখতে। ও ওখানে ভর্তি ITU-তে। আমি ছেলেকে দেখে নেমেছি, তখন পিয়ারলেস থেকে ফোন করে বলল আপনার স্ত্রীয়ের খুব খারাপ অবস্থা, পায়ে চ্য়ানেল করতে হবে। পারমিশন দিন। আমি তখন বললাম যেভাবেই হোক আপনারা দেখুন। হাসপাতাল থেকে বলল সঙ্গে সঙ্গে যেতে, আমার তখন মাথা কাজ করছিল না।' তারপর কোনওমতে হাসপাতালে পৌঁছন রাকেশ। সেখানে গিয়ে তিনি শোনেন তাঁর স্ত্রীকে ভেন্টিলেশনে দিতে হবে। তিনি বলছেন, 'আমি দেখা করতে চাইলাম। আমায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। দেড় ঘণ্টা পরে আমায় ঢুকতে দিল। আমি গিয়ে দেখি ওর নাকে-মুখে তিনটি চ্যানেল। শরীর ফুলে গিয়েছে দ্বিগুণ। আমি তখনই বুঝে গিয়েছিলাম আমি ওকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারব না।' কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে রাকেশের অভিযোগ, 'আমার স্ত্রী ফিট, নাচ করেন...কেউ কিছু করল না। আমার স্ত্রীকে খুন করেছে।'
রাকেশের অভিযোগ, 'আমায় তো মাতৃভবনই বলে দেবে কোথায় নিয়ে যেতে হবে। আমরা কোথা থেকে জানব। সিজার পেশেন্ট-একটা মশারি কেন দিল না।' মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাঁর আবেদন, 'আমি শুধু বলতে চাই, এটা শুধু ডেঙ্গি নয় এটা মেডিক্যাল নেগলিজেন্স। আমার স্ত্রী এক সন্তান, তাঁর বাবা-মাকে দেখতেন। মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করব ওঁর বাবা-মায়ের দিকটা যেন দেখা হয়।' বারবার চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ করেছেন রাকেশ। তাঁর দাবি, 'সিগারেটের প্য়াকেটের বাইরে লেখা হয় এটা বিপজ্জনক, হাসপাতালের বাইরে লিখুক এখানে ICU নেই, এটা বিপজ্জনক।'
ডেঙ্গির থাবা, প্রশাসনের গাফিলতি, চিকিৎসায় অব্যবস্থা (Medical negligency)। সব মিলিয়ে এক সদ্যোজাতের কাছ থেকে কেড়ে নিল তার মাকে। স্ত্রীকে হারালেন এক স্বামী। একমাত্র মেয়েকে হারালেন তাঁর বাবা-মা। আর কত কত পড়ুয়া হারাল এক শিক্ষককে।
আরও পড়ুন: 'বহরমপুরে এবার আর কেউ অধীর চৌধুরীকে জেতাতে পারবেন না',চ্যালেঞ্জ কান্দির তৃণমূল বিধায়কের