কৃষ্ণেন্দু অধিকারী, সমীরণ পাল ও শিবাশিস মৌলিক: দিল্লি দখলের লড়াইয়ে পরস্পরের শরিক হিসেবে সমঝোতা হলেও, বাংলায় তৃণমূলের (TMC) বিরুদ্ধে লাগাতার আক্রমণ শানিয়েই চলেছে কংগ্রেস (Congress)। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপিত অধীর রঞ্জন চৌধুরী (Adhir Ranjan Chowdhury) খোদ চাঁচাছোলা ভাষায় আক্রমণ শানাচ্ছেন জোড়াফুল শিবিরের বিরুদ্ধে। তার পরেও পাল্টা জবাব দিচ্ছে না তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। সেই নিয়েই রাজনৈতিক মহলে তৈরি হয়েছে জল্পনা। বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে, বাংলায় সংখ্যালঘু ভোট নিজেদের পক্ষে রাখতেই কি কংগ্রেস সম্পর্কে এখন নীরব অবস্থান নিয়েছে তৃণমূল? এর নেপথ্যে অনেকে উত্তরবঙ্গের ভোট-সমীকরণের কথাও ভাবছেন।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে কেন্দ্রে বিজেপি বিরোধী I.N.D.I.A জোটের অংশ কংগ্রেস, তৃণমূল, দুই দলই। সম্প্রতি জোটের বৈঠকে সনিয়া গাঁধী, রাহুল গাঁধীর পাশেই দেখা গিয়েছে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। রাহুলের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতের পর জোটে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। প্রকাশ্য মঞ্চে রাহুলকে 'খুব প্রিয়' বলেও উল্লেখ করেছেন মমতা। কয়েক মাস আগেও যেখানে রাহুলের নেতৃত্বদানের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মমতা-অভিষেক, সেখানে হঠাৎ করে মতবদলের নেপথ্যকারণ নিয়ে নানা ব্যাখ্যা উঠে আসছে।
বিজেপি-র বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে কংগ্রেসকে পাশে না পেলে চলবে না, এই সত্য অনুধাবন করতে পেরেই তৃণমূল নেতৃত্বের আচরণে এই পরিবর্তন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক মহলের অনেকেই। দিল্লিতে একজোট হলেও, বাংলায় প্রদেশ কংগ্রেস এবং তৃণমূলের সমীকরণে আগের সেই সখ্য ফিরে আসবে কিনা, তা নিয়েও কৌতূহলী ছিলেন অনেকেই।
কিন্তু বিগত কয়েক দিনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ধারাল আক্রমণেই যেতে দেখা গিয়েছে প্রদেশ কংগ্রেসকে। সময় পেলেই তৃণমূলকে তুলোধনা করছেন অধীর। কিন্তু কংগ্রেসের তরফে আক্রমণ এলেও, তৃণমূল কার্যত মুখ বুজেই রয়েছে। পাল্টা আক্রমণ তো দূর, প্রতিক্রিয়া জানানো থেকেও মোটামুটি বিরত থাকছে তারা।
তাই বিশেষজ্ঞদের একাংশের প্রশ্ন, কংগ্রেসের প্রতি তৃণমূলের এই নরম মনোভাবের নেপথ্য়ে কি রয়েছে সংখ্যালঘু ভোটের সমীকরণ? কারণ
প্রায় ৩০ শতাংশ সংখ্য়ালঘু ভোট বাংলার যে কোনও নির্বাচনে বড় ফ্য়াক্টর। এই সংখ্য়ালঘু ভোটের প্রায় পুরোটাই এখন তৃণমূলের দখলে। কিন্তু সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত ভোটে দেখা গিয়েছে, মুর্শিদাবাদ, মালদা, উত্তর দিনাজপুরের মতো জেলায় সংখ্য়ালঘুদের একাংশ ফের কংগ্রেসের দিকে ঝুঁকেছে।
সংখ্য়ালঘু অধ্য়ুষিত সাগরদিঘি বিধানসভা কেন্দ্রের উপ নির্বাচনেও কংগ্রেসের কাছে পরাজিত হয়েছিল তৃণমূল। তাই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, বিজেপি-র বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতা, বিভাজনের রাজনীতির অভিযোগে, কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত রাহুলের 'ভারত জোড়ো যাত্রা'র পরে রাজনীতির ক্যানভাসে ধারণা বদলের রং লেগেছে। আর তাই মোদি বিরোধিতায় যদি রাহুলকে প্রধান মুখ হিসেবে মনে করছেন সংখ্য়ালঘুরা। তাহলে কি লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় সংখ্য়ালঘুদের একাংশ ফের কংগ্রেসের দিকে ঝুঁকতে পারে? তেমনটা হলে কি খেসারত দিতে হতে পারে তৃণমূলকে? তাই সংখ্য়ালঘু ভোট অটুট রাখতে কংগ্রেসকে পাশে পেতে মরিয়া তারা? উঠছে প্রশ্ন।
ফ্যাক্টর আরও একটি রয়েছে। সেটা অবশ্যই উত্তরবঙ্গকে ঘিরে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গের ৮ জেলায় তৃণমূলকে হোয়াইট ওয়াশ করে দিয়েছিল বিজেপি। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত মালদা দক্ষিণ আসনটি দখল করেছিল কংগ্রেস। রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভা আসনের মধ্যে উত্তরবঙ্গে রয়েছে ৫৪টি। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের বিধানসভা ভিত্তিক ফলের নিরিখে, এই ৫৪টি আসনের মধ্যে বিজেপি এগিয়ে ছিল ৩৭টিতে, তৃণমূল ১৩টি এবং কংগ্রেস ৪টিতে এগিয়ে ছিল। এর পর ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে, বিজেপি বাংলায় যে ৭৭টি আসনে জয়ী হয়, তার মধ্যে উত্তরবঙ্গেরই ৩০টি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে। অর্থাৎ গোটা রাজ্যে পাওয়া আসনের প্রায় অর্ধেকই তারা পায় উত্তরবঙ্গ থেকে।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, ফারাক্কার ওপারে মালদা, উত্তর দিনাজপুর-সহ উত্তরবঙ্গের ৮ জেলায় কংগ্রেসের পুরনো ভোট ব্যাঙ্ক রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিজেপি-কে টেক্কা দিতে, উত্তরবঙ্গে কংগ্রেসকে পাশে পেতে চাইছে তৃণমূল। কিন্তু শেষ অবধি কি হাইকম্য়ান্ড প্রদেশ কংগ্রেসের কথা শুনবে, না কি বহু পুরনো সম্পর্ককে ফের ঝালিয়ে নিতে মমতার হাত ধরবেন? এটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন।