আলিপুরদুয়ার: ম্যাপে দেখলে মনে হতে পারে, উত্তরের এই জেলা বোধহয় একেবারে একচিলতে। কিন্তু আলিপুরদুয়ারের (Alipurduar) বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য তার আয়তন নয়, ভূ-প্রকৃতি (Geography) থেকে ইতিহাস (history), সর্বত্র ছড়িয়ে (Unknown Facts)। শুধু চোখ তুলে দেখে নেওয়ার অপেক্ষা। শুরু থেকে শুরু করা যাক?


ইতিহাস:
রাজ্য় সরকারের হেরিটেজ কমিশনের সাইট বলে দিচ্ছে, আলিপুরদুয়ার বা ইংরেজিতে Alipurduar নামটির তিনটি অংশ রয়েছে।  'Ali', 'Pur' ও 'Duar'। এর মধ্যে 'Pur' বা'পুর' কথাটির অর্থ বাসস্থান, আর দুয়ার শব্দটি এসেছে Dooars থেকে। কিন্তু 'আলি'? এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আর এক ইতিহাস। ছোট করে বললে ভুটান যুদ্ধে কর্নেল হেদায়েত আলি খানের অবদানকে শ্রদ্ধা জানাতেই তাঁর নাম থেকে 'Ali' অংশটি নেওয়া। ১৮৬৫ সালে দ্বিতীয় অ্যাংলো-ভুটান যুদ্ধের পর এই এলাকায় প্রথম অতিরিক্ত সহকারী কমিশনার হিসেবে পোস্টেড ছিলেন তিনি। সুপারঅ্যানুয়্যাশনে থাকাকালীন গোটা অঞ্চল কর্নেল আলি খানকে লিজ দেওয়া হয়েছিল। তার পর থেকে চা বাগান ও রেল যোগাযোগের  অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় ওই এলাকা। পরে প্রশাসনিক গুরুত্বও বাড়ে। 


অবস্থান:
অসম সীমানা ঘেঁষা পশ্চিমবঙ্গের একেবারে উত্তর পূর্ব প্রান্তের এই জেলার আনাচে কানাচে ঘন জঙ্গল, বন্যপ্রাণ, কাঠ, চা আর চোখজুড়ানো নৈসর্গিক সৌন্দর্য। বস্তুত ডুয়ার্স এলাকার সিংহভাগ নিয়েই আলিপুরদুয়ার। কালজানি নদীর পূর্ব তীরে এই জেলার সদর দফতর যা কিনা ভুটান ও উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলির প্রবেশদ্বার হিসেবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ম্যাপ বলছে,আলিপুরদুয়ারের ঠিক উত্তরেই ভুটান, পশ্চিমে জলপাইগুড়ি, পূর্বে অসম ও দক্ষিণে কোচবিহার।


ভূ-পরিচয়:
৩ হাজার ১৩৬ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে থাকা আলিপুরদুয়ার নদী, ঝরনা ও পাহাড় দিয়ে ঘেরা। তোর্সা, রায়ডাক, কালজানি, সঙ্কোশ এবং গদাধরের মতো নদী এই জেলার বুক চিরে বয়ে গিয়েছে। মাটির ধরন মোটা ও সুক্ষ্ণ দোআঁশ, দুরকম মিলিয়ে মিশিয়েই রয়েছে। চা-চাষই এখানকার ইউএসপি। নিদেনপক্ষে ৬৫টি চা বাগান রয়েছে আলিপুরদুয়ারে। 


অর্থনীতি:
চা বাগান এখানকার অর্থনীতির বড় মেরুদণ্ড। তা ছাড়া রয়েছে পর্যটন। পাহাড় থেকে জঙ্গল, পর্যটনপ্রেমী মানুষদের জন্য সব সাজিয়ে রেখেছে আলিপুরদুয়ার। তা ছাড়া জলদাপাড়া ওয়াইল্ডলাইফ স্যানচুয়ারি, বক্সা টাইগার রিজার্ভ ও উত্তর-পূর্ব ফ্রন্টিয়ার রেলের ডিভিশনাল হেড কোয়ার্টারও এখানেই।  
 
রাজনীতি:
২০১৪ সালের ২৫ জুন জলপাইগুড়ি জেলার ডুয়ার্স অংশকে আলাদা করে তৈরি হয় আলিপুরদুয়ার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে সময় বলেছিলেন, স্থানীয়দের দাবি মেনেই আলিপুরদুয়ার সাব ডিভিশনকে আলাদা জেলা করা হল এবং এর ফলে বাসিন্দাদের সুবিধা হবে। নবগঠিত আলিপুরদুয়ারের সিংহভাগ বাসিন্দাই আদিবাসী সম্প্রদায়ের। রাজবংশী, রাভা, সাঁওতাল, মদেশীয়, বোরো, টোটো ও ওঁরাওদের নিয়ে তৈরি আলিপুরদুয়ারে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে গেরুয়া-ঝড় দেখা গেলেও পরে ছবিটা খানিক হলেও বদলে যায়। বিশেষত পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে উত্তর-পূর্বের এই জেলার রাজনীতি প্রায়ই চর্চার বিষয় হয়েছে।     


উল্লেখযোগ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা:
আকাশপথে যেতে হলে বাগডোগরা বিমানবন্দর যোগাযোগের সবচেয়ে সহজ মাধ্যম। আলিপুরদুয়ার থেকে এই বিমানবন্দরের দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার। গুয়াহাটির বোরঝার বিমানবন্দরের দূরত্ব ৩০০ কিলোমিটার। ট্রেনে আসতে চাইলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত। সবচেয়ে কাছের স্টেশন নিউ আলিপুরদুয়ার এবং আলিপুরদুয়ার জংশন। তা ছাড়া সড়কপথে আলিপুরদুয়ার-শিলিগুড়ি, আলিপুরদুয়ার-জলপাইগুড়ি রুটের বেসরকারি বাস পরিষেবা রয়েছেই।


পর্যটন:
এই জেলার হৃৎপিণ্ড পর্যটন। আপনি যদি জঙ্গল ভালোবাসেন, তা হলে চিলাপাতা অরণ্য অবশ্যই ঘুরে দেখে যেতে পারেন। হাসিমারা থেকে মেরেকেটে কয়েক মিনিট দূরে এই ফরেস্ট হাতিদের অত্যন্ত প্রিয় করিডোর। যদি পাখিদের ভালোবাসেন, তা হলেও চিলাপাতা আপনাকে নিরাশ করবে না। একসময়ে এই জঙ্গল রাইনোসরাসদের আশ্রয়স্থল ছিল। কে বলতে পারে,বরাত ভালো থাকলে তাদের সঙ্গেও মোলাকাত হবে না? এবার আসা যাক, টোটোপাড়ায়। মাদারিহাট থেকে মোটে ২২ কিলোমিটার দূরে, জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের একেবারে নাকের ডগায় এই দুরন্ত সুন্দর জায়গাটি আসলে এক আদিবাসী গ্রাম। টোটো সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য পরিপাটি করে সাজানো এখানে। দেখলে ফিরতে ইচ্ছা হয় না। আলিপুরদুয়ারে এসে জলদাপাড়া না গেলে যেন হয়ই না। এই জাতীয় উদ্যানের ভিতর দিয়েই বয়ে গিয়েছে তোর্সা নদী। হাতির পিঠে সফর এখানকার অন্যতম আকর্ষণ। তা ছাড়া বক্সা ফোর্ট,বক্সা টাইগার রিজার্ভ, কুঞ্জনগর ইকো পার্ক তো রয়েছেই। কাকে ছেড়ে কাকে দেখবেন?   


অন্যান্য:
৬৬ টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ৬টি পঞ্চায়েত সমিতি, ৬ টি ব্লক ও ২ টি মিউনিসিপ্যালিটি ও ১টি সাব ডিভিশন। মোটের উপর এই নিয়ে তৈরি জেলা প্রশাসন নিরন্তর পরিষেবা দিয়ে চলেছে সেখানকার ১৫ লক্ষেরও বেশি বাসিন্দাকে। রয়েছে পর্যটনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। তবে মরসুম বুঝে গেলে আনন্দ বেশি। প্রকৃতি সব সময়ই অকৃপণ আলিপুরদুয়ারের উপর। শুধু ঘুরে দেখার, বুঝে নেওয়ার অপেক্ষা।


(তথ্যসূত্র: https://alipurduar.gov.in/aboutus.html


  https://www.wbtourism.gov.in/destination/district/alipurduar)


আরও পড়ুন:৫০ লক্ষ টাকা, স্করপিও গাড়িতে সমঝোতা! মমতার নির্দেশে CPM বিধায়ক কিনেছিলেন, দাবি শুভেন্দুর