হুগলি: 'গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি', কবিগুরুর এই পঙতিটি যেন হুগলি জেলার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। গঙ্গার পশ্চিমপাড়ের এই জেলার সৃষ্টিই নদীকেন্দ্রিক। সেই বহমানতা রয়েছে এখানের সাহিত্য, ধর্ম, ইতিহাস, সংস্কৃতি, জীবিকা-সবেতেই। ইতিহাস গাঁথা এখানের প্রতিটি জনপদে, শিক্ষাঙ্গনে, স্থাপত্যে। মনসামঙ্গল কাব্যগ্রন্থে বর্ণিত বেহুলা-লখিন্দরের সেই কাহিনী এই জেলাতেই বহমান। দিগন্ত বিস্তৃত ধানের ক্ষেতেও ভেসে চলে বাঁশুরিয়ার 'বৈচিত্র এক সুর'। সে সুরের মূর্ছনায় আজও আবিষ্ট এই জেলা।



নামের ইতিহাস, ইতিহাসের নাম

যে জেলায় এমন বৈচিত্র্য, এমন গৌরবময় প্রাচুর্য্য, সে জেলার নামের উৎপত্তি কীভাবে তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। ঠিক কোন সময়ে এই নামকরণ হয়েছিল তা যদিও তথ্যসংকলিত নয়। তবে রেভারেন্ড লং সাহেবের লেখা 'On the Banks of Bhagirathi' বইটিতে তিনি লিখেছেন, 'Hugly is a modern name given to it, since the town of hugly rose into importance'। ঐতিহাসিক টলেমি, মেগাস্থিনিস, ব্রিটিশ কর্নেল ক্রফোর্ড কিংবা মহাকবি কালিদাসের 'রঘুবংশ' লেখায় আলাদা করে হুগলির নামোল্লেখ না থাকলেও নদী এবং এলাকার বর্ণনায় সব লেখাতেই এই অঞ্চলটিকে ব্যক্ত করা হয়েছে একাধিকবার। এমনকী, হিউ-এন-সাঙ- এর লেখায় দক্ষিণ রাঢ়ের কিয়দংশ বলতে এই জেলাটির দিকনির্দেশ কিন্তু রয়েছে। তবে পরবর্তীতে হান্টার সাহেবের লেখা এবং ঐতিহাসিকদের সম্মিলিত মত থেকে বলা হয়- ভাগীরথীর তীরের এই এলাকায় প্রচুর হোগলা গাছ ছিল, সেই থেকেই এর নাম হুগলি। যদিও ব্রিটিশ-ফরাসি এবং পতুর্গিজদের বহু লেখায় এই হুগলির - 'ওগোলি, ওগলি, গোলিন, হিউগলি, গোলি' নাম রয়েছে।


মানচিত্রে জেলা-চিত্র

নামের ইতিহাসের মতো এ জেলার মানচিত্র-ইতিহাসের সময়কাল নিয়েও নানা মুনির নানা মত রয়েছে। জেলার কথা জানতে হলে টাইমমেশিনে চড়ে একেবারে শতক পেরিয়ে থামতে হবে ১৫৩৬ সালে, যখন পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দ্য-গামা হুগলি নদীর এ পাড়ে পা রাখেন। সেই সময় ব্যবসা বাণিজ্যর জন্য পারমিটও নিয়েছিলেন মহম্মদ শাহের কাছ থেকে। প্রথমে বর্ধমান জেলার মধ্যেই ছিল হুগলি। ১৭৯৫-এ হুগলিকে পৃথক জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই সময় সি এ ব্রুস এই জেলার প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত করা হয়েছিল। টয়েনবি সাহেবের লেখা 'A Sketch of the administration of the hooghly distrcit'-এ হুগলিকে অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।  বিপ্রদাসের চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যপথের লেখায় বৈদ্যবাটি-ভদ্রেশ্বর থেকে কোন্নগর-রিষড়ারও উল্লেখ রয়েছে। 'দিগদর্শন' পত্রিকায় যেমন বলা হয়েছে, 'হুগলি শহর ক্ষুদ্র কিন্তু প্রাচীন। পূর্বে অতি বড় ছিল, এখন তাহার প্রায় কিছুই নাই। বন্দরও ছিল। পরে তাহাই কলিকাতা হল।' অর্থাৎ এই লেখা থেকে আন্দাজ করা যায় এর প্রাচীনত্বকে। বঙ্গোপসাগর এবং নদীসঙ্গম থেকে এই জেলা যে খুব দূরে ছিল না তাও আন্দাজ করা যায়। রেনেল সাহেবের ১৭৮০ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত The Hoogly River from Nuddeah to the sea with Balasore Road লেখায় বলা হয়েছে, 'পূর্ব মানচিত্রের সহিত বর্তমান ভাগীরথীর তুলনা করিলে, এই নদীর গতি যে কত পরিবর্তিত হইয়াছে, তাহা দেখিলে বিস্মিত হইতে হয়।' উল্লেখ্য,  ভাগীরথীর পাশাপাশি দামোদর-রূপনারায়ণ-সরস্বতী নদীর প্রবাহও এই অঞ্চলে ছিল বলে বেঙ্গল গেজেটিয়র থেকে জানা যায়। পরবর্তীতে নদীপথ শুকিয়ে তা লোকবসবাসযোগ্য হয়ে যায়। বদল আসে মানচিত্রে। যা থেকে যায় তা ভৌগলিক ইতিহাস।


বর্তমান মানচিত্র অনুযায়ী, এই জেলার উত্তরে অবস্থান করছে পূর্ব বর্ধমান জেলা,পশ্চিমে আছে বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কিছু অংশ, দক্ষিণে হাওড়া জেলা এবং পূর্ব দিকটিকে ঘিরে রেখেছে নদিয়ে জেলা। এর পূর্ব দিক বরাবরই বয়ে গেছে হুগলী নদী। প্রায় ৩১৪৯ বর্গমিটার স্থান জুড়ে হুগলি জেলা অবস্থিত। আয়তনের বিচারে পশ্চিমবঙ্গে জেলাটি চতুর্দশতম স্থান অধিকার করে৷ ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে প্রায় ৫৫,২০,৩৮৯ জন লোক বসবাস করেন৷ এই জেলায় বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যাই বেশি। শতাংশের বিচারে  প্রায় ৮৭.৪৯%। এছাড়া হিন্দি (৭.৭৭%), উর্দু (১.৭২%), সাঁওতালী (২.৩৭%) ভাষার মানুষের বসবাসও রয়েছে৷ হুগলি জেলায় চারটি মহকুমা রয়েছে। চুঁচুড়া সদর, চন্দননগর, শ্রীরামপুর, ও আরামবাগ। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে অর্থনৈতিক দিক থেকে হুগলি জেলা বেশ উন্নত। গঙ্গার দুই তীরে পাট শিল্পের রমরমা ছিল৷ ত্রিবেণী, ভদ্রেশ্বর, চাঁপদানী, শ্রীরামপুরে ছিল এই শিল্পতালুক। ভারতবর্ষের সব থেকে বড় মোটর নির্মাণ কারখানা হিন্দুস্তান মোটর প্লান্ট গড়ে উঠেছিল এই জেলার হিন্দমোটরে৷ এই জেলা অর্থনীতি ও শিল্পে উন্নত হলেও জেলার ৫০% মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। এই জেলার অন্তর্গত আরামবাগ মহকুমা ও জাঙ্গীপারা, পান্ডুয়া, ধনিয়াখালি প্রভৃতি অঞ্চলগুলি মূলত কৃষি ভিত্তিক। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদল এসেছে। বন্ধ হয়েছে হিন্দমোটর কারাখানা বরং সে জমিতে শহুরে হাওয়া তৈরি হয়েছে মস্ত আবাসন। মফস্বলী জেলা আজ অবশ্য শহরমুখী।

জেলার প্রকৃতি

হুগলি নদীমাতৃক হলেও ছয় ঋতু এখানে বর্তমান। শীত ও গ্রীষ্মের আধিক্য রয়েছে, তবে তা বায়ুর প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। দখিনা এবং উত্তুরে হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলায় প্রকৃতি। গঙ্গার তীরবর্তী জেলা তাই বায়ুতে আর্দ্রতা কিছুটা বেশি থাকে। অতিবৃষ্টি এবং অনাবৃষ্টির ফলে যদিও চাষবাসে সমস্যা হয়েই থাকে। পাশাপাশি এই জেলায় কারখানার আধিক্য বেশি থাকায় সেই প্রভাবও পড়েছে প্রকৃতিতে। শতাব্দী ধরে বিচার করলে হুগলির গঙ্গা এবং বায়ু- দূষণ বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত। একসময়ের সর্বশ্রেষ্ট জলের আধার 'গঙ্গাজল' যদিও আর 'মনোহারী মুরারী চরণচ্যুতম' নেই। তবে আবহাওয়ার যে উল্লেখযোগ্য বদল ঘটেছে তা আন্দাজ করা যায় 'কলিকাতা গেজেটে' প্রকাশিত বেন্টলি সাহেবের লেখা একটি কবিতা থেকে ১৮৬২ সালের ব্যান্ডেলের আবহাওয়ার উল্লেখ থেকে। সেখানে তিনি লিখেছেন, 'each other place is hot as hell, when breezes fan you at bandel/ had I ten houses all i'd sell, and live entirely at bandel'। যদিও বঙ্গের রাজ-রাজড়াগণের একসময়ের বাসস্থানে এখন প্রবেশ করেছে 'বিষবায়ু'। তাই বদলেছে আজকের হুগলি প্রকৃতি।

হুগলি- ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন

হুগলি জেলায় যেহেতু নানাবিধ ভাষার সমন্বয় ঘটেছিল (বিদেশি উপনিবেশ থাকার জন্য) তাই সংস্কৃতিরও মেলবন্ধন রয়েছে এই এলাকায়। রয়েছে সব প্রথিতযশা নামও। নানা ক্ষেত্রে দিকপাল তাঁরা। ভাষা চর্চা থেকে বিপ্লব, সমাজ সংস্কার, চিকিৎসাক্ষেত্র- হুগলির রত্নভাণ্ডার পূর্ণ সেই নামে। ভাবলে অবাক হতে এই এই হুগলিতে বসেই ১৭৮৫ সালে চালর্স উইলকিন্স প্রথম বাংলা মুদ্রাক্ষর খোদাই করে তা 'A Grammer of the Bengal Language' মুদ্রণের জন্য তৈরি করেন। বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যর নবজাগরণের যে সময় সেই উনবিংশ শতাব্দীতে শ্রীরামপুরের মিশনের অধ্যক্ষ ডক্টর উইলিয়াম কেরির হাত ধরে হুগলিতে বিস্তার লাভ করে। বাংলা সাহিত্যর আরেক পুরোধা রাজা রামমোহন রায় এই হুগলি জেলারই। সাহিত্য থেকে ধর্ম-সংস্কার, বাংলার ইতিহাসে এই নাম থেকে গিয়েছে স্বর্ণাক্ষরে। কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, প্যারিচাঁদ মিত্র (টেকচাঁদ ঠাকুর), ভূদেব মুখোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্যাকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র রামগতি ন্যায়রত্ন, কলকাতার প্রথম বাঙালি শেরিফ রাজা দীগম্বর মিত্র, বাংলা টপ্পা সঙ্গীতের সংস্কারক রামনিধি গুপ্ত (নিধিবাবু), বিপ্লবী মতিলাল রায়, নবগোপাল মিত্র, শিবচন্দ্র দেব, কবি অক্ষয়কুমার বড়াল, নীলমণি দাশ, নগেন্দ্রনাহ বসু, সাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল), প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এই জেলারই সন্তান। এমনকী দেশের প্রথম পোস্টমর্টেম করেছিলেন যে বাঙালি সেই মধুসূদন গুপ্ত হুগলি জেলারই বৈদ্যবাটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। 

এছাড়াও হুগলি জেলায় জন্ম না হলেও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শিক্ষা-দীক্ষার লীলাভূমি ছিল এই জেলা। চুঁচুড়ায় জোড়াঘাটের বাড়িতে বসেই বুনেছিলেন 'আনন্দমঠ', 'দুর্গেশনন্দিনী'র সাহিত্যজাল। এই হুগলিরই দেবানন্দপুর গ্রামে জন্মেছিলেন 'কথাশিল্পী' শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। অগ্নিযুগের বিপ্লবী ঋষি অরবিন্দের স্মৃতিধন্য কোন্নগরও এই জেলাতেই। এই জেলাতেই জন্ম যোগপুরুষ অবতার রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের। সংস্কৃতি-ধর্ম-ইতিহাস-বিপ্লবে তাই হুগলির নাম উঠে আসে বারংবার।

রাজনীতিতে হুগলি

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হুগলি বরাবরই একটি চর্চার নাম। তা সে যে সময়কালই হোক না কেন। স্বাধীনতার আগে কিংবা স্বাধীনতার পরে হুগলির রাজনীতি সমীকরণ বদলেছে বহুবার। কংগ্রেস আমল থেকে বাম আমল হয়ে বর্তমানে তৃণমূল সরকারের ক্ষমতায় আসা এবং বহমান রাজনীতিতে হুগলি থেকে গিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সিঙ্গুরে ন্যানো প্রকল্পের জন্য তৎকালীন বাম সরকারের ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন বাম সরকার। যার মধ্যে প্রায় ৪০০ একর জমির দাতা ছিলেন ‘অনিচ্ছুক’। সিঙ্গুরের মাটিতে দাঁড়িয়ে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরবর্তীতে তৃণমূল সরকারের ক্ষমতায় আসা এবং বঙ্গ রাজনীতিতে 'টাটা বিতর্ক' আজও রয়ে গেছে এই হুগলিতে। সময়ের পালে হাওয়া তুলে ঘাসফুলের মাঝে লেগেছে গেরুয়া রঙও। চিরবিদ্রোহের মাটিতে তাই আজও চলছে উত্থান-পতনের লড়াই।

স্থাপত্য-ইতিহাসের আনাচ-কানাচ

ইতিহাসে যে জেলার নাম উঠে আসে একাধিকবার সে জেলায় ইতিহাস ছোঁয়া যাবে না, তা কী করে হয়? মন্দির-মসজিদ-গির্জা-পীঠস্থান, এক জেলাতেই বহু স্থান। উত্তরপাড়ার জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরি, কোন্নগরের রাজরাজেশ্বরী মন্দির, ঋষি অরবিন্দের বাড়ি, অবনীনন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাগানবাড়ি, রিষড়ায় রাধাবল্লভের মন্দির, শ্রীরামপুরে রাজবড়ি, ডেনমার্ক ট্যাভার্ন, হেনরি মার্টিনস প্যাগোডা, উইলিয়ম কেরির সমাধি, বৈদ্যবাটিতে ডাকাত কালি মন্দির, চন্দননগরে স্ট্র্যান্ড রোড, চুঁচুড়ায় ঘড়ি মোড়,আর্মেনিয়ান চার্চ,  ব্যান্ডেল চার্চ, ইমামবাড়া, হংসেশ্বরী মন্দির,লাহিড়িবাবার আশ্রম, সিদ্ধেশ্বরী মন্দির- দর্শনীয় স্থান অনেক।

তাছাড়া কামারপুকুর, তারকেশ্বর, ফুরফুরা শরিফের মতো ধর্মীয় স্থান রয়েছে, যেখানে প্রতিদিন ভক্তসমাগম ঘটে।




তথ্যসূত্র :



  • হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ - সুধীরকুমার মিত্র

  • Hooghly Past And Present By Shumbhoo Chunder Dey

  • Calcutta Gazette, 1787

  • Bengal District Gazetteers, Hooghly - L.S.S. O'Malley, 1912

  • https://hooghly.nic.in/