মুর্শিদাবাদ- এই জেলার নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক টুকরো ইতিহাস। পলাশির যুদ্ধ, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার হার, বাংলায় ইংরেজ শাসনের ভিত্তি স্থাপন... আরও কত কী। একসময় বাংলার নবাবদের প্রিয় শহর ছিল মুর্শিদাবাদ। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বিখ্যাত এই জেলা বহু মানুষের প্রিয় পর্যটন কেন্দ্রও বটে। নবাব আমলের প্রচুর স্মৃতি এখনও ছড়িয়ে রয়েছে এই ঐতিহাসিক জেলা জুড়ে। ইতিহাসে মোড়া এই জেলার আনাচে কানাচে রয়েছে অনেক গল্প। পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে এই জেলার গুরুত্বও অনেক।


ইতিহাস- মুর্শিদাবাদ জেলার নামকরণ হয়েছে 'মাকসুদাবাদ' থেকে। নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ- এর আমলে বাংলার রাজধানী ছিল এই 'মুকসুদাবাদ'। ব্রিটিশদের আগমনের আগে বাংলার রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ শহর। ভারতের ইতিহাসে মুর্শিদাবাদের গুরুত্ব অপরিসীম। ১৭৫৭ সালের পলাশির যুদ্ধের কথা ইতিহাসের পাঠ্য বইয়ে পড়ে ছেলেবেলায় শিহরিত হননি এমন বাঙালির সংখ্যা নেহাতই হাতেগোনা। এই যুদ্ধেই বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। এরপরই বাংলায় শুরু হয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকাল। ইতিহাস অনুসারে, ইংরেজরা বাংলা অধিগ্রহণ করার পরে বেশ কিছু সময়কাল ধরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিভিন্ন ধরনের প্রশাসনিক কাজকর্ম এই মুর্শিদাবাদ থেকেই করেছিল। 


নবাব আমলে মুর্শিদাবাদ ছিল সুবে বাংলার (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা এবং বাংলাদেশ) রাজধানী। খ্রিস্টিয় সপ্তম শতাব্দীতে গৌড় অঞ্চলের রাজা শশাঙ্কের রাজধানীও ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার কর্ণসুবর্ণ অঞ্চলে। এছাড়াও বাংলার অন্যতম পাল রাজা মহীপালের রাজধানী শহরও সম্ভবত এই জেলাতেই ছিল। মুর্শিদাবাদ জেলার ইতিউতি এখনও ছড়িয়ে রয়েছে নবাব আমলে তৈরি মসজিদ, সমাধি, বাগান এবং আরও অনেক কিছু। এছাড়াও এই অঞ্চল এখনও হাতির দাঁতের তৈরি শিল্পকর্ম, সোনা এবং রুপোর সূচিশিল্প ও রেশম বুননের মতো ঐতিহ্যশালী শিল্পকলাকে ধরে রেখেছে। বলা হয় মাকসুদাবাদ, যেখান থেকে মুর্শিদাবাদের নামকরণ হয়েছে সেই মাকসুদাবাদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুঘল সম্রাট আকবর, ষোড়শ শতাব্দীতে।উল্লেখ্য, মুর্শিদাবাদ- এই নামকরণ হয়েছিল ১৮ শতকের গোড়ার দিকে। 


অবস্থান- মুর্শিদাবাদ গঙ্গার শাখানদী ভাগীরথীর পূর্বদিকে অবস্থিত। আকৃতির দিক থেকে এই জেলা এমন একটি ত্রিভুজের মতো দেখতে যার দুই বাহুর দৈর্ঘ্য সমান। পশ্চিমবঙ্গের মাঝ বরাবর অবস্থিত এই জেলা বিস্তৃত রয়েছে ৫৩১৬.১১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। মুর্শিদাবাদ জেলার পূর্ব সীমানা দিয়ে বয়ে চলেছে পদ্মা নদী। বাংলাদেশের রাজশাহী এবং বাংলার মালদা জেলা থেকে মুর্শিদাবাদকে আলাদা করেছে এই নদীই। মুর্শিদাবাদের দক্ষিণভাগে রয়েছে বর্ধমান এবং নদিয়া জেলা। আর পশ্চিম অংশে রয়েছে বীরভূম এবং ঝাড়খণ্ডের পাকুড়। মুর্শিদাবাদ জেলার মূল নদী ভাগীরথী এই জেলাকে দুটো মূল অংশে বিভক্ত করেছে। একটি হল 'বাগড়ি' যা রয়েছে পূর্বদিকে। আর একটি পশ্চিমভাগের 'রাঢ়' অংশ। বাংলাদেশের সঙ্গে ১২৫ কিলোমিটারের বেশি এলাকা জুড়ে আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে মুর্শিদাবাদ জেলার। মুর্শিদাবাদ জেলার উত্তরে রয়েছে মালদা জেলা এবং বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা। উত্তর-পূর্বে রয়েছে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা, দক্ষিণে নদিয়া জেলা, দক্ষিণ-পশ্চিমে পূর্ব বর্ধমান জেলা, পশ্চিমে বীরভূম জেলা এবং উত্তর-পশ্চিমে ঝাড়খণ্ডের পাকুড় জেলা ৷


ভূ-পরিচয়- মূলত রাঢ় এবং বাগড়ি অংশই ঘিরে রয়েছে মুর্শিদাবাদ জেলাকে। পশ্চিমভাগে অবস্থিত রাঢ় আসলে ছোট নাগপুর মালভূমির একটি উচ্চ ধারাবাহিক অংশ। পূর্বদিকে রয়েছে বাগড়ি এলাকা যা আদতে উর্বর পলিমাটি যুক্ত নিচু অংশ। এটি গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপের অংশ বলেও জানা যাচ্ছে। মূল নদী গঙ্গা এবং তার শাখানদী ভাগীরথী ছাড়াও মুর্শিদাবাদ জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে জলঙ্গী নদী। পূর্বদিকে আবার রয়েছে ভৈরব নদীও। এছাড়াও রয়েছে দ্বারকা, ময়ূরাক্ষী, সুতী এবং আরও অনেক নদী। মুর্শিদাবাদ জেলা একটি নিচু এলাকা এবং এখানে রয়েছে উর্বর পলিমাটি। এই জেলায় ক্রান্তীয় আর্দ্র এবং শুষ্ক জলবায়ু লক্ষ্য করা যায়। গরমের সময় তাপমাত্রা বেশ চড়া থাকে। এই জেলায় বেশ ভাল রকমের কালবৈশাখীর প্রভাব দেখা যায়। আবার শীতের মরশুমে একধাক্কায় অনেকটা পারদ পতনও লক্ষ্য করা যায় মুর্শিদাবাদ জেলায়। 


অর্থনীতি- কৃষিকাজের পাশাপাশি নবাব আমলে উত্থান হওয়া মুর্শিদাবাদের অন্যতম আকর্ষণ এখানকার সিল্ক বা রেশমের বুনন। মুর্শিদাবাদের সিল্কের শাড়ি জগৎবিখ্যাত। এই জেলার অর্থনীতির অনেকটাই নির্ভর করে রয়েছে এই সিল্ক ইন্ডাস্ট্রির উপরেই। এছাড়াও ফলের রাজা আমের ফলনের জন্যও বিখ্যাত মুর্শিদাবাদ জেলা। এখান থেকে সেরা গুণমানের আম বিদেশের বাজারেই রপ্তানী করা হয়। ১৭০৪ সালে নবাব মুর্শিদকুলি জাফর খাঁ বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন। এর পরবর্তী সময়ে নবাবদের উৎসাহেই মুর্শিদাবাদ জুড়ে অসংখ্য আম ফাছ রোপণ করা হয়। তৈরি হয় বিভিন্ন আম বাগান। মুর্শিদাবাদের কোহিতুর আম বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হয়। এছাড়াও মুর্শিদাবাদের অর্থনীতিতে জড়িয়ে রয়েছে বিড়ি শিল্পও। 


রাজনীতি- স্বাধীনতা উত্তর সময়ে দীর্ঘ প্রায় দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে মুর্শিদাবাদ কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি ছিল। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এই জেলায় বেশ কিছু জনপথে মুসলমান সম্প্রদায়ই সংখ্যাগুরু। সার্বিক ভাবে সে সময়ে গোটা দেশে সংখ্যালঘুদের মধ্যে কংগ্রেসের জনভিত্তি ছিল খুবই মজবুত। ১৯৭৭ সালে বাংলায় পালা বদলের পর মুর্শিদাবাদে ক্রমশ শক্তি বাড়ায় বামেরা। রাজ্যে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার সুফলও এই জেলায় পেয়েছিল সিপিএম ও তাদের শরিক দল আরএসপি। কিন্তু বাম জমানাতেও কান্দি বিধানসভায় কংগ্রেসের বিধায়ক অতীশ সিংহ বা বহরমপুরে অধীর চৌধুরী ছিলেন উজ্জ্বল। অতীশ সিংহ রাজ্য বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা ছিলেন। তা ছাড়া বামফ্রন্ট জমানাতেও লাগাতার বহরমপুর পুরসভা ছিল কংগ্রেসের দখলে। শুধু তা নয়, বহরমপুর লোকসভা আসনে বাম জমানাতেও পর পর তিন বার ভোটে জিতেছিলেন অধীর চৌধুরী। বাংলায় বাম সরকার পতনের পরেও মুর্শিদাবাদ কংগ্রেস এবং সিপিএম তাঁদের শক্তি অনেকটাই ধরে রাখতে পেরেছিল। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে জেলার তিনটি আসনের মধ্যে দুটি পেয়েছিল কংগ্রেস, একটিতে জিতেছিল সিপিএম। তা ছাড়া ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটেও বাম, কংগ্রেস জেলায় গরিষ্ঠ সংখ্যক আসনে জেতে। কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে মুর্শিদাবাদে ভরাডুবি হয় কংগ্রেস, সিপিএমের। জেলায় একটি আসনও জিততে পারেনি তারা। মুর্শিদাবাদে এখন তৃণমূল কংগ্রেসই পুরসভা, পঞ্চায়েত বা বিধানসভায় নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় রয়েছে।


মুর্শিদাবাদ জেলা পাঁচট মহকুমা নিয়ে গঠিত। বহরমপুর, ডোমকল, কান্দি, জঙ্গিপুর, লালবাগ। এছাড়াও ৮টি পুরসভা রয়েছে মুর্শিদাবাদে। মোট ২২টি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে এই জেলায়। মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশ পাঁচটি সার্কেলে বিভক্ত। এই জেলায় মোট ২৯টি থানা রয়েছে।  


উল্লেখযোগ্য- বাংলার ইতিহাসে মুর্শিদাবাদের গুরুত্ব অপরিসীম। একসময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসনিক কার্যালয় ছিল মুর্শিদাবাদ। তার আগে বাংলার নবাবদের অন্যতম পছন্দের জায়গা ছিল মুর্শিদাবাদ। আর সেই কারণেই তৎকালীন এই শহর গড়ে তোলা হয়েছিল নবাবি আদব-কায়দায়। আজও মুর্শিদাবাদ জেলায় সেইসব নিদর্শন দেখা যায়। ইতিহাসের গন্ধ লেগে রয়েছে মুর্শিদাবাদের অলিতেগলিতে। নবাব আমলে ফুলেফেঁপে ওঠা মুর্শিদাবাদ তাই পর্যটনের জন্য অন্যতম উল্লেখযোগ্য স্থান। মুর্শিদাবাদ জেলার সিল্কের শাড়ি বিশেষ করে বালুচরি শাড়ির কথা না বললেই নয়। মুর্শিদাবাদ জেলার বালুচর এলাকায় তৈরি হয় এই দুর্দান্ত শাড়ি। ডিজাইন এবং রঙ সবেতেই নজরকাড়া বালুচরি শাড়ির চাহিদা সর্বত্র। আর রয়েছে রেশম সুতো দিয়ে তৈরি শাড়ি। এই জেলার রেশম শিল্পও বিশ্ববিখ্যাত। মুর্শিদাবাদ বেড়াতে গেলে তাই সংগ্রহে একটা সিল্কের শাড়ি অন্তত নিয়ে ফেরেন অনেকেই। এছাড়াও শোলার কাজ এবং পিতলের কাজের জন্যও বাংলার এই জেলা বেশ বিখ্যাত। 


যোগাযোগ ব্যবস্থা- মূলত সড়ক এবং রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে কলকাতা-সহ অন্যান্য উল্লেখ্যযোগ্য শহরের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে মুর্শিদাবাদ জেলা। এই জেলার সদর দফতর বহরমপুরের সঙ্গেই মূলত সড়ক এবং রেল যোগাযোগ রয়েছে। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ যাওয়ার জন্য বাসরুট সবচেয়ে ভাল। কলকাতা থেকে বহরমপুরের দূরত্ব প্রায় ১৮২ কিলোমিটার। ট্রেনের তুলনায় সময় কিছুটা বেশি লাগলেও এই যাতায়াত বেশ সস্তার। এছাড়াও রয়েছে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। দক্ষিণবঙ্গ থেকে মুর্শিদাবাদ ট্রেনে যেতে চাইলে মালদাগামী ট্রেনেই যাওয়া সম্ভব। এছাড়াও বহরমপুর থেকেও যাওয়া যাবে মুর্শিদাবাদ।


পর্যটন- শীতের মরশুম হোক কিংবা বছরের যেকোনও সময়েই ছোটখাটো একটা উইকেন্ড ট্রিপের জন্য মুর্শিদাবাদ আদর্শ জায়গা। হাতে একটু বেশি সময় থাকলে ভাল। নাহলে ইতিহাস প্রেমীদের মনে হতে পারে কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবেন। কারণ নবাবদের আমলে তৈরি প্রচুর নিদর্শন রয়েছে মুর্শিদাবাদে, যা আপনাকে এক নিমেষে মুগ্ধ করতে পারে। মুর্শিদাবাদ বলতে প্রথমেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে হাজারদুয়ারি প্যালেসের কথা। হাজার দরজার এই আলিশান প্যালেসের অন্য নাম নিজামত কিলা। এছাড়াও রয়েছে মোতি ঝিল, মুরাদবাগ প্যালেস এবং খোশবাগ সমাধি। হাতের তৈরি বিভিন্ন ধরনের তাক লাগানো জিনিসও পেয়ে যাবেন এই জেলায়। তাই ঘোরা বেড়ানোর সঙ্গে শপিংও করা যাবে সাধ মিটিয়ে। মুর্শিদাবাদ গেলে নিজামত ইমামবড়া, কাটরা মসজিদ, নসিপুর প্যালেস, কাঠগোলা প্যালেস জাফরগঞ্জ সমাধি, জাহানকোশা তোপ এলাকা দেখতে কিন্তু একেবারেই ভুলবেন না। এছাড়াও রয়েছে আরও অনেক মন্দির, মসজিদ, সমাধি, স্মৃতি সৌধ, নবাবদের তৈরি আলিশান প্যালেস ও আরও অনেক কিছু। একবারে মুর্শিদাবাদ জেলা পুরো ঘুরে চাক্ষুষ করা সম্ভব নয়।


তথ্যসূত্র