কলকাতা : স্মৃতি ঘাঁটতে গেলে অনেককিছুই তো টাইমলাইনে উঠে আসে। নতুন বছর , নতুন ইনিংস, নতুন ভাবনা। আসলে নতুন কিছু শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অনেক আশা প্রত্যাশা জড়িয়ে থাকে তাকে ঘিরে। ঠিক যেমনটা হয়, কর্মজীবনের শুরুতে । হয়ত অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে মনে পড়ে যায় কাজ- জীবনের সেই পয়লা দিনগুলোর কথা। কিছু মুহূর্তের কথা। কিছু সাক্ষাতের কথা। ফিরে যায় মানুষ কোনও বিশেষ সময়ে। ১৪২৯ সালের পয়লা মাসে দাঁড়িয়ে এবিপি লাইভের সঙ্গে এমন কিছু পুরনো স্মৃতির কথা ভাগ করে নিলেন বিশিষ্টরা। এবিপি লাইভের সঙ্গে আলাপচারিতায় ডাক্তারি জীবনের শুরুর দিকের স্মৃতির কোলাজ করলেন শহরের বিশিষ্ট চিকিৎসক কুণাল সরকার । অনেক স্মৃতির ভিড়ে মনে পড়ে গেল, সেই যুগের কথা যখন ক্ল্যাসিকাল পদ্ধতির বাইরে গিয়ে হার্ট সচল রেখে অপারেশন করা শুরু করেছিলেন একদল তরুণ চিকিৎসক। তাঁর মধ্যে এগিয়ে ছিলেন ডা. সরকার।
আরও পড়ুন :
' ব্রেস্ট ক্যান্সার থেকে সুস্থ করে হাতে পেয়েছিলাম কৌটোভরা নারকেল নাড়ু, সেই অনুভূতি কখনও ভুলব না '
সেটা ছিল ৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়। তখন কলকাতা শহরে বাইপাস সার্জারি আজকের মতো প্রচলিত ছিল না। মানুষ কিছুটা এড়িয়েই চলতেন বাইপাস-সার্জারি। তখন সপ্তাহে একটার বেশি অপারেশন নয়, এমনটাই বলে দেওয়া হত। আস্তে আস্তে সংখ্যাও যেমন বাড়ল, তেমনই আসতে শুরু করল বেশ কিছু নতুন রকমের সমস্যাও। তখন ৯৭ সাল। স্মৃতিতে ডুব দিলেন ডা. সরকার। ' সেই সময় আমরা বিটিং-হার্ট-সার্জারি শুরু করলাম। আমরাই সেই চেঞ্জওভার প্রজন্ম ছিলাম। আমরাও কত কী শিখছি রোজ। সে সময় ইমার্জেন্সিতে একজন রোগী এলেন। তিনি একজন জাপানের নাগরিক। কাজের সূত্রে তাঁর জাহাজ ভেড়ে হলদিয়া বন্দরে। তিনি জাহাজে থাকাকালীনই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। দেখা যায়, তাঁর অনেকগুলি ব্লকও আছে হার্টে, বাইপাস করা প্রয়োজন। কিন্তু সামনে এল এক নতুন চ্যালেঞ্জ। ওই ভদ্রলোক ছিলেন খ্রিস্টান Jehovah's Witnesses সম্প্রদায়ভুক্ত। তাঁরা খুবই রক্ষণশীল । তাঁদের গেঁড়া বিশ্বাস, অপারেশনের সময় অন্য কারও রক্ত নেওয়া চলবে না। এটা তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিপন্থী। আমার ১১ বছরের অভিজ্ঞতায় এমন ঘটনা ঘটেছে। তবে এখানে এমন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে ভাবিনি। তিনি অসম্ভব গোঁড়া। কিছুতেই রাজি নন তিনি ব্লাড ট্রান্সফিউশনে। তাঁর পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা হল, তাঁরাও রাজি নন । ধর্মীয় বিশ্বাসে তাঁরা অনড়। ঝুঁকি থাকলেও ! তখন আমরা একটা উপায় বার করলাম। ওষুধের মাধ্যমে তাঁর হিমোগ্লোবিন বাড়িয়ে তাঁরই কিছুটা রক্ত সংগ্রহ করা হল। যদিও সাধারণত হার্টের রোগীদের থেকে রক্ত নেওয়া হয় না, সেটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। সেই ঝুঁকিটা নিতে হল। এবং সফল ভাবে অস্ত্রোপচারও হল। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে, বিটিং হার্ট সার্জারির যে প্রধান ভাল দিক, বাইরে থেকে কম ব্লাড দিয়েও অপারেশন হয়, সেটা সফলভাবে করা গেল। অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম আমরা। ব্লাড ট্রান্সফিউশন ছাড়াই তাঁর চারটি বাইপাস অপারেশন হল ! এই অপারেশনটা আমার ডাক্তারি জীবনের বিরাট বড় একটা চ্যালেঞ্জ।
হয়ত আরও অনেক ঘটনাই ঘুরে ফিরে আসে । তবে কিছু ঘটনা তো মনে গেঁথে থাকে । ঠিক যেমন মনে পড়ে, আমি তো ইংল্যান্ডে গিয়েছিলাম প্লাস্টিক সার্জারি করতে। কিন্তু সিনিয়রদের উৎসাহে আমি হার্ট সার্জারিতে এসে পড়লাম। সেই সময় কলকাতায় আস্তে আস্তে হার্ট সেন্টার গুলি গড়ে উঠছে। ঠিক যেন, পিঠ চাপড়ে কাজ করিয়ে নেওয়া। আমি গোল্ড মেডেল পেয়েছিলাম, কিন্তু কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে আমি কোনওদিন হার্ট সার্জারি দেখিনি। প্রথম যেদিন দেখেছিলাম লিভারপুলে মানুষের হার্ট, সেই উদ্দীপনা, বিস্ময় ভুলব না কোনওদিন।
রবি ঠাকুরের কথায় ' নববিস্ময়ের আনন্দ' ! সেটা যেন আমার চেতনাকে ধাক্কা দিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। '