কলকাতা : তিনি স্রষ্টা। তাঁর হাতেই তৈরি হয় দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি। অথচ মনে কোনও সংস্কারকে বাসা বাঁধতে দেননি তিনি। এখনও বহু শিক্ষিত মানুষের মনেই যেখানে ঋতুস্রাবকালে পুজো করা নিয়ে ছুঁৎমার্গ, সেখানে সেই সময় ধন্দ কাটিয়ে উঠেছেন শিল্পী মালা। 



কুমোরটুলিতে ৮০র দশকের মাঝামাঝি থেকে ঠাকুর গড়ছেন অধুনা স্বনামধন্যা এই শিল্পী। সেই সময় বাড়ির মেয়েদের কুমোরটুলিতে এসে ঠাকুর গড়া নিয়ে কত বাধা ! অথচ সেইসব কাটিয়ে উঠেছেন। প্রশিক্ষণ নিতে পাড়ি দিয়েছেন রাজধানী শহরে। সেখান থেকে অত্যাধুনিক কর্মপদ্ধতিতে পোক্ত হয়ে কাজ শুরু করেছেন কলকাতার কুমোরটুলিতে। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি থেকে বাড়ির বৌয়ের প্রতিমা গড়া নিয়ে সামান্য বাধা এলেও দাদার সহায়তায় তা অতিক্রম করেছেন। এ হেন লড়াকু মালা পাল কথা বলেন অত্যন্ত ক্ষীণ স্বরে। আচার ব্যবহারে ঝরে পড়ে স্নেহ। মাটি নিয়ে দিনভর কাজ করা মানুষটির মন মাটির মতোই নরম। তাবলে কোনও কুসংষ্কারকে সেই মাটিতে জাঁকিয়ে বসতে দেন না। পুজোর বাকি আর মোটে এক সপ্তাহ। কাজ চলছে পুরোদমে। মাথা তোলার সময় নেই ! তার মাঝেই এবিপি লাইভের সঙ্গে কথা বললেন। প্রতিমায় তুলির টান দিতে দিতে শিল্পী বললেন, এখন কি নাওয়া-খাওয়ার সময় আছে নাকি যে, এইসব নিয়ে ভাবব ! 

কথা হচ্ছিল, ঋতুস্রাবের সংষ্কার মানা-না-মানা নিয়ে । মালা পাল স্পষ্টই জানিয়ে দিলেন, উদ্যোক্তাদের হাতে সময় মতো প্রতিমা তুলে দেওয়া ছাড়া কাজের সময় মাথায় কিচ্ছু থাকে না। তখন কাজ বন্ধ রাখা সম্ভব নাকি ? 'ওইসব দিনেও কাজ করি' বললেন মালা। তিনি মনে করেন, কাজের থেকে বড় শুচিতা কিচ্ছুতে নেই। আর মন যেখানে শুদ্ধ, কাজ যেখানে মোক্ষ, সেখানে ঋতুস্রাবের কথা আসে কী ভাবে ? 

এক সময় ঋতুকালে আলাদা ঘরে থাকতেন মহিলারা। সেই কাল এখন গত। মেয়েরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন যে কোনও পেশায়। মাসের ওই কটা দিনও বিশ্রামহীনভাবে কাজ করে যান মহিলারা। কিন্তু এখনও অনেকেই মানেন, ওই সময় পুজোর কাজ করতে নেই ! অথচ ঋতুস্রাবের সঙ্গে শারীরিত শুচিতার কোনও সম্পর্ক নেই , এ কথা বোঝাতে একটা চলচ্চিত্রই তৈরি হয়ে গেছে 'ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি' । এই ছবির গল্প যাঁকে ঘিরে সেই নন্দিনী ভৌমিকও মনে-প্রাণ বিশ্বাস করেন ঋতুকালে পুজো করতে কোনও বাধা নেই, তিনি করেনও। মহিলারা বিশেষ দিনে আবার পুজো করতে পারেন নাকি ? বিভিন্ন সময় তাঁর কাছে  প্রশ্ন তুলেছে সমাজ। এবিপি লাইভের কাছে তিনি বললেন, 'আমরা পুজোয় বসেই বিষ্ণুকে স্মরণ করে বলি, 'ওঁ   অপবিত্রঃ পবিত্রো বা সর্বাবস্থাং গতোঽপি বা। যঃ স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষং স বাহ্যাভ্যন্তরঃ শুচিঃ।' যার অর্থ  বাহ্য শরীর ও শরীরের অভ্যন্তরে স্থিত মনের কোনও একটি বা দুটিই যদি অপবিত্র হয়, তবে পদ্মলোচন শ্রীবিষ্ণুকে স্মরণ করা মাত্রই বাহ্য ও অন্তরে শুদ্ধ হওয়া যায়। তাহলে এই মন্ত্র স্মরণ করলে আর অশুচি তো কিছুই থাকে না। তাই ঋতুকালে পুজো করতে অসুবিধা কি ?  নন্দিনী ভৌমিক জানান, তিনি নিজেই নারায়ণশিলা পুজো করেন, নিজের কোলে নিয়েই। তাতে কোনও দোষ নেই। 

এখনও  যাঁরা মেনস্ট্রুয়াল সাইকল চলছে বলে, অঞ্জলি দেবেন কি না ভাবেন, তাঁরা আরও একবার ভেবে দেখুন মালা পাল বা নন্দিনী ভৌমিকের কথা। যাঁরা ঠাকুর গড়া বা দেবীর আবাহনে যুক্ত থাকেন, তাঁরাই ভাবেন অন্যভাবে।