শুভেন্দু ভট্টাচার্য, কোচবিহার : কোচবিহারের ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত বড় দেবী বা বড় মা । কথিত আছে মহারাজা বিশ্ব সিংহ প্রথমে খেলার ছলে বড় দেবীর পুজোর সূচনা করেন। পরবর্তীকালে মহারাজা নরনারায়ণের আমলে এই পুজো শুরু হয় আনুমানিক ১৫৩০ সাল নাগাদ। হিসেব কষলে, এই পুজো এখন প্রায় ৫০০ বছরের। (Durga Puja 2023) 


এই পুজোকে কেন্দ্র করে জড়িয়ে রয়েছে নানা রকম কথা ও কাহিনি। একসময় এই পুজোয় নরবলি প্রচলিত ছিল তবে বলা হয় একবার মাত্র হয়েছিল নরবলি, পরে বন্ধ হয়ে যায় । তবে পুজোতে এখনও মানুষের রক্তের প্রয়োজন হয়। সন্ধি পুজোর দিন অনুষ্ঠিত হয় গুপ্ত পুজো আর সেখানেই মানুষের রক্তে তুষ্ট করা হয় দেবীকে।  (Cooch Behar Durga Puja) 


এই পুজোর সূচনা কিন্তু হয়ে যায় অনেক আগে থেকেই । শ্রাবণ মাসের শুক্ল অষ্টমীতে গুঞ্জবাড়ির ডাঙ্গর আই মন্দিরে ময়না কাঠের পুজোর মধ্য দিয়েই শুরু হয় বড় দেবীর আবাহন। এই ময়না কাঠের উপরেই তৈরি হয় বড়দেবীর প্রতিমা।  ডাঙ্গর আই  মন্দিরে ময়না কাঠটি পুজো করে সন্ধেবেলা নিয়ে আসা হয় মদনমোহন মন্দিরে। সেখানে এক মাস চলে সেই ময়না কাঠের পুজো, তারপরে তাকে স্থাপন করা হয় বড়দেবী মন্দিরে, সেখানে তিনদিন ময়না কাঠকে  হাওয়া খাওয়ানোর পর শুরু হয় প্রতিমা নির্মাণের কাজ।  

এই পুজোর পদ্ধতি এবং প্রতিমা দুটোই স্বতন্ত্র। বড় দেবী এখানে রক্তবর্ণা, তার সঙ্গে থাকে না তাঁর ছেলে মেয়ে লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ, বদলে তাঁর সঙ্গে থাকেন দুই সখী জয়া ও বিজয়া। দেবীর বাহন এখানে বাঘ ও সিংহ। প্রাচীন রীতিমেনে পুজো করা হয় বড় দেবীকে। প্রাচীন তালপাতার পুঁথির মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে আবাহন করা হয় কোচবিহারের বড় দেবীকে।  (Religion)

এই পুজোতে রয়েছে বলি প্রথা অষ্টমীর দিন মহিষ বলি হয়। এছাড়াও পায়রা , পাঁঠা, এবং বিসর্জনের সময় শুকর বলির রীতি আছে। একসময় কোচবিহারের মহারাজারা এই পুজো করতেন এখন তো মহারাজারা নেই,  তাই পুজোর দায়িত্বে  ট্রাস্টবোর্ড। এই ট্রাস্টবোর্ড রাজ্যের পর্যটন দফতরের অধীনে। প্রথা অনুযায়ী অষ্টমীতে জেলা শাসক প্রথমে বড় দেবীকে অঞ্জলি দেন । তারপরে অঞ্জলি দিতে পারেন অন্য ভক্তরা। প্রতিবছর কয়েক হাজার মানুষ ভিড় করে এই বড় দেবী পূজা উপলক্ষে, শুধুমাত্র কোচবিহার জেলা নয় পার্শ্ববর্তী অসম থেকেও প্রচুর ভক্ত আসেন এই পুজো দেখতে।  


দশমীর পুজোর পর সকাল সকাল বড় দেবী মন্দিরের পাশেই যমুনা দীঘিতে বিসর্জন দেওয়া হয় দেবীকে। ট্রলিতে করে চাপিয়ে  রশি টেনে শয়ে শয়ে ভক্ত মাকে নিয়ে আসে যমুনা দিঘির পাড়ে, সেখানে খণ্ডিত করা হয় দেবীর শরীরের বিভিন্ন অংশ তারপর একে একে বিসর্জন দেওয়া হয় বড় মাকে। 

এই পুজোকে কেন্দ্র করে কোচবিহারের মানুষের আবেগ জড়িত রয়েছে, কোচবিহারের অনেকেই আগে বড় দেবীকে প্রণাম করে তারপর অন্য দুর্গাদর্শন করেন। এছাড়াও বড় দেবী বিসর্জন হওয়ার পরেই বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় শুরু করেন কোচবিহারের মানুষজন।


বছরের পর বছর ধরে এই ধারা অব্যাহত রয়েছে । শতশত বছরের ঐতিহ্য পরম্পরা আজও অক্ষুন্ন।