শাল্মলি বসু, কলকাতা: রাজার সঙ্গে বিবাদই যেন শাপে বর হয়েছিল। একঘরে হয়ে কলকাতায় (Kolkata) আসার সিদ্ধান্ত। কিন্তু স্ত্রীয়ের প্রসব যন্ত্রণায় বজরা থামল আন্দুলে। তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জমিদারি বিস্তার থেকে পুজোর সূচনা। নিয়ম নিষ্ঠা ভরে তিনশো বছর ধরে মাতৃ আরাধনা (Durga Puja 2023) করে আন্দুলের (Andul) রায় পরিবার।
পুজোর ইতিহাস: প্রায় তিনশো বছরের পুরনো আন্দুলের রায় পরিবারের পুজো। যশোর জেলার চেঙ্গুটিয়াতে বাস ছিল এই পরিবারের। শোনা য়ায়, রাজার সঙ্গে বিবাদে এক ঘরে হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। চার ভাইয়ের মধ্যে দুই ভাই কলকাতায় আসার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পথেই থামে এক বজরা। স্ত্রীয়ের প্রবল প্রসব যন্ত্রণায় নেমে যেতে হয় আন্দুলে। পরবর্তীকালে এই রতিদেব কুশারির হাত ধরেই পুজোর সূচনা। সেই সময় আন্দুল ছিল একেবারেই অনুন্নত একটা জায়গা। ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান সেখানে আসায় রীতিমতো উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন স্থানীয়রা। আশেপাশের লোকজনের সাহায্য এবং কর্মবলে জমিদারি তৈরি করেন রতিদেব। বর্ধমানের রাজার থেকে পেয়েছিলেন 'রায়' উপাধি।
কিন্তু এই বিপুল সম্পত্তির অধিকারী কে হবে? পুত্র সন্তান ছিল না রতিদেবের। একমাত্র কন্যার বিয়ে নিয়ে সেসময় চিন্তায় পরিবার। হুগলির হরিপাল থেকে সেসময় মহেশ্বর বটব্যাল নামে এক শাঁখারি শাঁখা বিক্রি করতেন আন্দুলে। তাঁকেই ভরসাযোগ্য বলে মনে করেন রতিদেব। বিয়ে দেন মেয়ের সঙ্গে। জমিদারি থেকে রায় উপাধি রতিদেব দেন তাঁর জামাইকে। সেই সময় থেকেই দুর্গাপুজোর সূচনা। প্রায় তিনশো বছর ধরে সাবেকিয়ানা বজায় রেখেই দেবী দুর্গার আরাধনা করছে এই পরিবার।
আন্দুলের এই বাড়িতেই রয়েছে ঠাকুর দালান। একটা সময় ঠাকুর তৈরি হত দালানেই। তবে করোনা পরিস্থিতিতে নিয়ম খানিক বদলেছে। পরিবারের এই প্রজন্মের সদস্য রণদীপ রায় বলেন, “ঠাকুর তৈরির কাজ বেশ কিছুটা হয় অন্যত্র। তবে রং করা, চক্ষু দান হয় দালানেই।’’ অতীতে বলি প্রথা ছিল। তবে এখন বদলেছে সেই নিয়ম। কোনও রকম বলিতে রাজি নয় সদস্যরা।
পুজোর ক’টা দিন রীতিমতো গমগম করে বাড়ি। বর্তমানে সদস্য সংখ্যা ২০। তবে পুজোর দিনগুলিতে যে যেখানে আছে এসে হাজির হয় বাড়িতে। উৎসবের দিনগুলিতে মিলেমিশে কাজ করে সবাই। ষষ্ঠীর সকাল থেকেই শুরু হয় ব্যস্ততা। বাড়ির কচিকাঁচারা অস্ত্র, গয়না পরায় মাকে। বিকেলে পঞ্জিকা মেনে হয় বোধন। অষ্টমীর দিন অন্নভোগ দেওয়া হয় দেবী দুর্গাকে। এছাড়াও পুজোর বাকি দিনগুলো দুবেলা ভোগ নিবেদন করা হয়। তবে একেবারেই নিরামিষ। পুজোর দিনগুলিতে আমিষ খাওয়ার রীতি নেই। প্রতিদিন একশো জনের পাত পড়ে পুজোর দিনে। বিসর্জনেও রয়েছে অভিনবত্ব। এই এলাকার সব ঠাকুরের বিসর্জন হয় বাড়ি লাগোয়া পুকুরে। এলাকার প্রতিটি ঠাকুর বিসর্জনের আগে উদ্যোক্তারা এই ঠাকুরের দর্শন করেন। সব শেষে জমিদার বাড়ির ঠাকুর বিসর্জন হয়।
অন্যান্য বাড়ির পুজোর সঙ্গে আরও একটা পার্থক্য আছে এই পুজোর। এই বাড়িতে দশমীর দিন হয় দক্ষিণরায়ের পুজো। সুন্দরবন অঞ্চলে বাঘের দেবতা হিসেবে পুজো করা হয় দক্ষিণরায়কে। দক্ষিণ হাওড়ার এই অংশে একটা সময় বন জঙ্গল ঘেরা এলাকা ছিল। কথিত আছে, বাঘের উপদ্রব কমাতে শুরু হয় দক্ষিণরায়ের পুজো। বাড়ির ঠিক বাইরেই রয়েছে দক্ষিণরায়ের মূর্তি। তবে ঝুড়ি চাপা থাকে। ছোট ছোট মাটির ঘোড়া, ব্যাঘ্র মূর্তি রয়েছে সেখানে। দুর্গাপুজোর দর্পণ বিসর্জনের পর এই পুজো করা হয়। এর পাশাপাশি পুজো হয় নীল ষষ্ঠীর দিনও। কেন ঝুড়ি চাপা? রণদীপ রায় বলেন, “অতীতে মন্দির তৈরির চেষ্টা হলেও, দেখা গিয়েছে সেই মন্দির ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। তাই সেই উদ্যোগ আর নেওয়া হয়নি। ’’