সোমনাথ মিত্র, হুগলি: শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব মত মিলিত হয় এই পুজোয়। এখানে দেবী পূজিত হন কালিকা পূরাণ মতে। অষ্টমীতে এখনও এখানে বসানো হয় জল ঘড়ি। ৪০০ বছর পার করল হরিপালের সাতবাড়ি রায় বংশীয় দূর্গাপুজো। এখনও এখানে প্রাচীন রীতিনীতি মেনে নিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হয় দুর্গাপুজো।
হাওড়া - তারকেশ্বর মেইন লাইনের হরিপাল স্টেশন থেকে দক্ষিণদিকে ১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রায়দের জমিদার বাড়ি। পরিবারের প্রবীণ ব্যক্তি প্রশান্ত কুমার রায় এর বক্তব্য অনুযায়ী, আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে তাদের বংশের পূর্বপুরুষ শিবদাস রায় এখানে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মপ্রাণ শিবদাস রায় তার জমিদারিতে একাধিক শিব মন্দির গড়ে তোলেন। কালের নিয়মে একাধিক শিব মন্দির ধ্বংস হয়ে গেলেও এখনও চারটে শিব মন্দির ভগ্নপ্রায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে। শিব মন্দিরের গায়ে প্রাচীন টেরাকোটার অপরূপ নিদর্শন জানান দেয় তার শিকড়ের কথা।
পরবর্তীকালে তৈরি হয় রাধা গোবিন্দের মন্দির, দোল মঞ্চ, রাস মঞ্চ। কিন্তু তখনও এখানে দুর্গা পূজার প্রচলন ছিল না। শিবদাস রায়ের সাত ছেলে। তার মধ্যে চারজন ছিলেন বৈষ্ণব মতাদর্শী আর অন্যরা ছিলেন শিবের উপাসক। সাত ছেলের হাত ধরে ১৬০০ খ্রীষ্ট্রাব্দে শুরু হয় দুর্গাপূজো। দুর্গা দালান তৈরি করে এক চালচিত্রে দূর্গা পুজো শুরু। বর্তমানে রায় বংশের দৌহিত্র্য ও পৌত্ররা এই পুজো দেখভাল করে আসছেন। পুজো পরিচালনা হয়, সাতবাড়ি রায়বংশীয় শ্রী শ্রী রাধাগোবিন্দ জীউ দেবত্তর এস্টেট কর্তৃক।
তখন থেকে আজও এক চালচিত্রে প্রতিমা তৈরী হয়। তপ্ত কাঞ্চন বর্ণ দেবী দূর্গা ও লক্ষীর , সবুজ রঙের মহিষাসুর , সাদা সরস্বতী, হালকা গোলাপী রঙের গণেশ, হালকা হলুদ রঙের কর্ত্তিক ঠাকুরের রঙেও কোন পরিবর্তন হয়নি। এক চাল চিত্রে মা দূর্গার নিচে থাকে লক্ষী ও সরস্বতী , তাদের উপরে থাকে গনেশ ও কার্তিক। কাঠামোর পিছেন শৈব, বৈষ্ণবের সাথে মা চন্ডীর ছবি আঁকা হয়। প্রতিমার মাথায় ষাঁড়ের উপর শিব বসে আছে এই রকম মূর্তি স্থাপন করা হয়।
রায় বাড়ির পুজোয় তিনটে নব পত্রিকা পূজিত হয়। নবমী থেকে প্রায় ১৫দিন আগে কৃষ্ণ নবমব্যাধি কল্পারম্ভে নব পত্রিকা পুজো করা হয়। সেই দিন থেকে সন্ধ্যাকালীন পুজো ও চন্ডী পাঠ শুরু হয়। এর পর মহালয়ার পরেরদিন আরও একটি নব পত্রিকা পুজো করে বোধনের ঘরে রাখা হয়। তারপর সপ্তমীতে আরো একটি নব পত্রিকা পুজো করে রাখা হয় গণেশের পাশে। প্রত্যেক ১৪ রকমের নৈবিদ্য নিবেদন করা হয় মায়ের কাছে। এখনও বলি প্রথার প্রচলন আছে এই পুজোতে। আগে সপ্তমীতে একটা, সন্ধিপূজোয় দুটো ও নবমীতে চারটে ছাগ বলি হত। পাশাপাশি নবমীতে মেষ ও মহিষ বলি হত।
বর্তমানে সপ্তমীতে একটা, সন্ধি পুজোয় একটা , এবং নবমীতে দুটো ছাগ বলি হয়। এরপর আখ, ছাঁচি কুমড়ো , গোড়া লেবুর পাশাপাশি রম্ভা বলি হিসাবে দেয়া হয়। আর মহিষের পরিবর্তে এখন ডাভ বলি দেয়া হয়। নিকটবর্তী হালদার বাড়ির ব্রাক্ষণরা এসে একটি পাত্রে জলঘড়ি প্রতিস্থাপনা করেন অষ্টমীর ভোরে। তখন থেকে সন্ধিক্ষণ পূজো অবধি সেই জলঘড়ি বসানো থাকে । পুজোয় প্রাচীন কাল থেকে একই বংশের পুরোহিতরা পুজো করে আসছেন। প্রতিমা ও তৈরী করেন একই বংশের শিল্পীরা। পঞ্চমীর দিন বাঁকুড়া জেলা থেকে প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা একই বংশের বাদ্যকাররা এসে পুজো মন্ডপে উপস্থিত হন।
পুজোর কয়েকটা দিন জমজমাট হয়ে ওঠে রায়েদের জমিদার বাড়ি। কলকাতা বা ভিন রাজ্যে পরিবারের যে সমস্ত সদস্যরা থাকেন তারা সবাই পুজোয় সমবেত হন। পুজোর কয়েকটা দিন আনন্দে কাটে সবার। এলাকার প্রচুর মানুষ ও ভিড় জমান প্রাচীন এই পুজো দেখতে। নতুন প্রজন্মের তরুণী দ্বৈতা রায় জানান, এই পুজো ছেড়ে আমরা অন্য পুজো দেখতে যাই না। সমস্ত বাড়িতেই আত্মীয়-স্বজন ভরে যায়। পুজোর কটা দিন জমজমাট থাকে আমাদের মন্ডপ। হই হুল্লোর করে কেটে যায় কয়েকটা দিন।
সুতো দিয়ে ঘিরে পুজো হয় না রায়দের প্রতিমার। ঠাকুরের সামনে ঘট পেতে শুরু হয় পুজো। তাই দশমীতে সুতো কাটার কোন ব্যাপার থাকে না। দশমীতে ঘট নাড়িয়ে দিয়ে পুজোর সমাপ্তি ঘোষণা করেন পুরোহিত। এরপর ঠাকুরকে নামিয়ে বরণ করেন পরিবারের পুরুষ ও ব্রাহ্মণরা। কোন মহিলারা বরণ করেন না। কণকাঞ্জলি নেন বাড়ির কোন এক পুরুষ। সেই দক্ষিণা রায় বাড়ির গুরুদেবের বাড়িতে যাওয়ার পর সেখানে লক্ষ্মীপূজা হয়। রায়দের দুর্গাদালনে হয় না কোন লক্ষীপূজা। এরপর প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা বাহকরা উপস্থিত হয় রায় দের বাড়িতে। তাদেরই কাঁধে চেপে বিসর্জন এর পথে রওনা দেয়, সাতবাড়ি রায় বংশের দুর্গা প্রতিমা। আবার ও প্রহর গোনা শুরু হয় সেই দিন থেকে।