হংসরাজ সিংহ, পুরুলিয়া: দু'দিন আগেই প্রাচীন পঞ্চকোট রাজবংশের দুর্গা পুজো শুরু হয়ে গিয়েছে। রাজবংশের প্রথা মেনে পুরুলিয়া জেলার কাশীপুরের দেবী বাড়িতে ১৫ তারিখে শুরু হয়েছে এই ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজো। এখানে দেবী পূজিতা হন রাজরাজেশ্বরী রূপে, চতুর্ভূজা অষ্টধাতুর মূর্তিতে এক বিশেষ মাহাত্ম্য নিয়ে।
রাজবংশের প্রথা মেনে কৃষ্ণা নবমীর দিন থেকেই দুর্গাপূজা শুরু হয় কাশিপুর দেবী বাড়ির মন্দিরে। কথিত রয়েছে রামচন্দ্র রাবণ বধের জন্য যে ১৬ দিনব্যাপী পুজো করে ছিলেন সেই ধারা মেনে এখানে ১৬ দিন ধরে মা পূজিতা হন। সেই কারণে এই পুজোকে ষোড়শ কল্পের পূজোও বলা হয়।
এখানে ষোড়শ কল্পের ষোড়শী রূপে মা পূজিত হন। একহাতে জপমালা, আর এক হাতে বেদ। বাকি দুই হাতে বরদান ও অভয়। গলায় নরমুণ্ডমালা। পঞ্চকোট রাজপরিবারের সদস্য তথা সিপাহী বিদ্রোহের মূল উদ্যোক্তা মহারাজাধিরাজ নীলমণি সিং দেও-র প্রপৌত্র সৌমেশ্বরলাল সিং দেও বলেন, 'পঞ্চকোট রাজ বংশের এই পুজো প্রায় দু'হাজার বছর প্রাচীন। শকাব্দ ২ থেকে এই পুজো হয়ে আসছে আমাদের কুলদেবতা রাজরাজেশ্বরী ঠাকুরদালানে। মা মন্দিরে সারা বছরই অধিষ্ঠিত থাকেন। এখানে আজও বলি প্রথা রয়েছে। মায়ের ভোগে থাকে মাছ, মাংস।'
ষোড়শপচারে পুজো হলেও এখানের দেবী মূর্তির রয়েছে বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য। কাশীপুরে এই দেবীবাড়িতে অষ্ট ধাতুর চতুর্ভুজা দেবীর আরাধনা করা হয়। এখানে দুর্গাপুজোর সপ্তমীর রাত্রে দেবীকে নীচে নামানো হয়, তারপর অলংকার দিয়ে শৃঙ্গার করানো হয়। রীতি অনুযায়ী এখনও দেবীকে তুষ্ট করার জন্য আগমনী গান সহ নৃত্য ও গানবাজনার আসর বসে। এখানকার পুজোর বিশেষত্ব হল মহাষ্টমীর দিন এখানে এক বিশেষ মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়, যাকে গুপ্তাতিগুপ্ত শ্রীনাথ মন্ত্র বলা হয়। পণ্ডিত রাখাল চন্দ্র বিদ্যারত্ন এই শ্রীনাথ মন্ত্র লিপিবদ্ধ করে যান।
দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিন দেবী মন্দিরে একটি পাত্রতে সিঁদুরের উপর রাজরাজশ্রীর পায়ের ছাপ পড়ে যা অবিশ্বাস্য হলেও, আজও সে ধারা অব্যাহত। মহাঅষ্টমীর সন্ধিক্ষণে এই শিখরভূমে মা দুর্গার পায়ের ছাপ দেখা যায়।
জানা যায়, প্রায় ২ হাজার বছর প্রাচীন এই রাজবংশের পুজো, বিক্রমাদিত্যের বংশধর মহারাজা জগতদল সিংহদেও কনিষ্ঠপুত্র দামোদর শেখর সিংহ দেও বাহাদুর এখানে চাটলা পঞ্চকোট রাজ স্থাপন করেন তখন থেকেই তিনি এই পুজো আরম্ভ করেন যা আজও চলছে। এই পুজো দুর্গাপুজোর মহা নবমীতে পুজা হয়ে দশমীতে ঘট বিসর্জনের মাধ্যমে পুজোর সমাপন হবে। আগের মত জৌলুস না থাকলেও পুজোর দিনগুলিতে রাজ বংশের উত্তরসূরীরা উপস্থিত থাকেন মন্দিরে। এখানে নিত্য পুজোতে অন্ন ভোগ দেওয়া হলেও ১৬ কল্পের এই পুজোর ভোগে থাকে বিশেষ আয়োজন। যা টানা ১৬ দিন ধরে চলে।
শুধুমাত্র জেলাবাসীই নয়, ভিন রাজ্য থেকেও পুজো দেখতে বহু মানুষ ভিড় জমান কাশিপুরের এই দেবীবাড়িতে।