কমলকৃ্ষ্ণ দে, পূর্ব বর্ধমান: আর মাত্র একটা দিন, তারপরেই দেবীর বোধন। সারা বাংলা মেতে উঠেছে পুজোর (Durga Puja 2023) আনন্দে। দশভুজার যে প্রতিমার সঙ্গে বাঙালি পরিচিত। এই পুজোয় সেই প্রতিমা দেখা যায় না। এখানে দেবীর রূপ একটু ভিন্ন। রয়েছে মহাদেবের উপস্থিতিও। পূর্ব বর্ধমানের বড়শুলের 'দে বাড়ি'তে হরগৌরি রূপেই পূজিতা হন দেবী।
দ্বিভুজা দেবী:
এখানে দেবী দুর্গা মহাদেবের বাম উরুতে অধিষ্ঠাত্রী। দেবী এখানে দশভুজা নন, দ্বিভুজা। লক্ষ্ণী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক-সকলেই রয়েছেন। গণেশ, কার্তিকের বাহন থাকলেও এখানে লক্ষ্মী, সরস্বতীর বাহন নেই।
কথিত রয়েছে পূর্ব বর্ধমানের (Purba Bardhaman) বড়শুলের 'দে বাড়ি'র পুজো অন্তত আড়াইশো বছরের পুরনো। এই পরিবারের পুজোর প্রচলন নিয়েও রয়েছে নানা কাহিনী। তখন নাকি বড়শুলের জমিদার যাদবচন্দ্র দে। প্রথমে তিনি নাকি ঘটে পুজো শুরু করেছিলেন। তারপরে জমিদার গৌরপ্রসাদ দে-এর আমল থেকে মূর্তিপুজো শুরু হয়। জমিদার বাড়িতে কীভাবে হরগৌরীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হল?
একটা মত, এই পরিবারের পূর্বপুরুষদের কেউ স্বপ্নাদেশ পেয়ে হরগৌরীর আরাধনা শুরু করেন। আর একটা মত হচ্ছে, একসময় এই জমিদার বাড়িতে সাধুসন্তরা এসে থাকতেন। কথিত আছে, জমিদার গৌরপ্রসাদ দে-র আমলে তেমনই কোনও সাধু এসে ঝোলা থেকে বেশ কয়েকটি ছবি বের করেছিলেন। তারপর পরিবারের এক শিশুকন্যার চোখ বেঁধে একটি ছবি বেছে নিতে বলেছিলেন তাঁরা। সেই শিশুকন্যা হরগৌরীর ছবিটি তুলেছিল। তখন থেকেই হরগৌরীর পুজো শুরু হয় এখানে। এই পরিবার বৈষ্ণব। তখন কুলগুরুর পরামর্শে শুরু হয় পুজো। পরিবারের বর্তমান সদস্য হিমাদ্রিশঙ্কর দে জানান, সপ্তমীতে গোটা ছাঁচিকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। অষ্টমীতে ছাগবলি হয়। নবমীতে তিনটে ছাঁচিকুমড়ো, চারটি শসা, বাতাবি লেবু ও মূলসহ তিনটি আখ বলি দেওয়া হয়। তবে বলি দেওয়া কোনও জিনিসই এই পরিবারের কেউ আহার করতে পারেন না। আগে সন্ধিপুজোয় বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা বাড়ির পুজোর কামানের আওয়াজ শুনে সন্ধিপুজোর বলিদান শুরু হতো। কিন্তু সেই কামান দাগা কয়েক দশক আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন ঘড়ির সময় দেখেই বলিদান হয়।
এই পরিবারের একসময় পানপাতা ও লবণের ব্যবসা ছিল। দামোদর পথে চলত বাণিজ্য। একসময়ের বনেদিয়ানা এখন অতীত। কলকাতা থেকে সড়কপথে এলে বড়শুল মোড় বা জাতীয় সড়ক থেকে শক্তিগড় স্টেশন যাওয়ার জন্য জাতীয় সড়ক থেকে নেমে প্রায় দেড় কিলোমিটার গিয়ে ডানদিকে বাঁক নিয়ে গলি রাস্তা ধরলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে 'দে' বাড়িতে। অতীতের আভিজাত্য, ঐতিহ্য, ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল অট্টালিকা। পলেস্তারা খসে পড়েছে বহু জায়গায়। তবে কয়েকটি বাড়িতে এখনও পরিবারের বংশধরেরা থাকেন। বাকিটা ফাঁকাই পড়ে রয়েছে। কাছারি বাড়ির ঠিক উল্টোদিকেই রয়েছে ঠাকুরদালান। সেখানেই রয়েছেন হরগৌরী। একটু দূরে রয়েছে কুলদেবতা রাজরাজেশ্বরের জিউ মন্দির।
পরিবারের সদস্য হিমাদ্রিশঙ্কর দে জানান, একসময় ঠাকুরদালানে রেড়ির তেলে ঝাড়বাতি জ্বলে উঠতো। দুর্গাপুজো উপলক্ষে আলোয় ঝলমল করে উঠত গোটা জমিদার বাড়ি। ঠাকুরদালানের প্রবেশ পথে ছিল বিশাল ঘণ্টা। সেইসব চুরি হয়ে গিয়েছে। পুজোযর জৌলুস এখন অনেকটাই ফিকে হয়েছে। কিন্তু পরম্পরা মেনে আজও নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো হয় এখানে। দশমীর দিনে দেবীকে বাঁশের মাচা বেঁধে কাঁধে করে গোটা গ্রাম ঘুরিয়ে তারপর বিসর্জন করা হয়।
আরও পড়ুন: সপ্তমীর হোমাগ্নি টানা জ্বলে দশমী পর্যন্ত! জৌলুস কমলেও রয়েছে নিষ্ঠা