পার্থপ্রতিম ঘোষ, আবির দত্ত, সুকান্ত মুখোপাধ্যায়, কলকাতা : মাত্র কয়েকটা মাস। বদলে গেল এলাকার মানচিত্র। বিরাট বিরাট জলাভূমি ভ্যানিশ। কোথাও টিনের প্রাচীর। কোথাও মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো পিলার। কসবার ১০৮ নম্বর ওয়ার্ড। এই মুহূর্তে চর্চার কেন্দ্রে। যেখানে জলাভূমির ওপর বেআইনিভাবে গড়ে উঠছে একাধিক নির্মাণ। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে চলছে জমি ভরাটের কাজ !
তবে কসবাকাণ্ডের পর জলাভূমি ভরাটের খবর সম্প্রচারিত শুরু হতেই, বদলে গেল ছবিটা। বুধবার দেখা গেল আর্থমুভারগুলি ঢেকে দেওয়া হয়েছে। আর বৃহস্পতিবার দেখা গেল, সেই জায়গাতেই আর নেই জলাশয় ভরাটের যন্ত্রগুলো। টিনের প্রাচীরের ফাক দিয়ে, ভিতরের কর্মকাণ্ডের ছবি তোলার চেষ্টা করতেই, সেই ফাঁকফোকর বন্ধ করে দিলেন নিরাপত্তারক্ষীরা। এবিপি আনন্দ-র সামনেই জলাভূমি ভরাটের জন্য রাবিশ নিয়ে একটি ট্রাক আসে। কিন্তু, আমাদের ক্যামেরা সামনে থাকায় গেটই খোলেননি নিরাপত্তারক্ষী। ফলে ফিরে যায় রাবিশভর্তি ট্রাক। বাসিন্দাদের জিগ্যেস করতেই বেরিয়ে আসছে সত্যি। শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যাচ্ছে না। জানা যাচ্ছে, জলাভূমি ভরাট করে নাকি হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে !
১০৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর সুশান্ত ঘোষের উপর হামলার পর, সামনে এসেছে একের পর এক জমি কেলেঙ্কারির অভিযোগ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগ, জলাজমি ভরাট করে অবৈধভাবে নির্মাণের। অভিযোগ তলায় তলায় ছিল বহুদিন। সুশান্ত ঘোষের ঘটনার পর একটার পর একটা ঘটনা সামনে আসছে। চলছে দোষারোপ, পাল্টা দোষারোপের পালা। আর সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা দেখলেই তড়িঘড়ি ঢাকার চেষ্টা করা হচ্ছে।
পূর্ব কলকাতার জলাভূমি । যেখানে বিগত কয়েক বছর ধরে ছিল জলাশয়, চারিদিকে প্রচুর সবুজ, সেখানে এখন কংক্রিটের জঙ্গল। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পিলার। নির্মাণকাজের ধুলোয় ঢেকেছে আকাশ। সম্প্রতি রীতিমতো আর্থমুভার নামিয়ে চলেছে জলাশয় ভরাটের কাজ। অথচ গত বছর অবধি সেখানে ছিল শুধুই জলাজমি। অথচ একবছরের মধ্যেই বদলে গিয়েছে এলাকার মানচিত্র। জলভাগ কমছে, গ্রাস করছে নির্মাণ। জলাশয়ের মধ্যেই বিশাল জায়গা জুড়ে তোলা হয়েছে পাঁচিল। সেখানে রমরমিয়ে চলছে জলাভূমি ভরাট করার কাজ।
স্যাটেলাইট ক্যামেরায় চোখ রাখলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে পরিবর্তনের ছবিটা। মাত্র কয়েক বছরেই ওয়ার্ডের ছবিটা বদলে গিয়েছে বেমালুম। ১০৮ নম্বর ওয়ার্ড এ, যেখানকার কাউন্সিলর সুশান্ত ঘোষ। এই ওয়ার্ডেরই এলাকার নাম নোনাডাঙা। যেখানে বিগত কয়েকবছর ধরে জলাভূমি ছিল। সেখানে এখন আর জল দেখা যায় না। ২০২০, ২০২১, ২০২২ এও যেখানে জলাভূমি ছিল, এমনকী এবছর মে মাসেও ছিল জল, সেখানেই এখন বড় বড় আর্থমুভার নামিয়ে ভরাট করে ফেলা হয়েছে জমি।
আরও একটি জায়গাও এখন আলোচনায় । গুলশন কলোনি। তারই পাশে মার্টিনপাড়া। ছবিটা একইরকম। সেখানে বিরাট জলাভূমি। সেখানে আগে জলাভূমি থাকলেও জলের মাঝে কোনও পাঁচিল ছিল না। কিন্তু এখন সেখানে দেখা যাচ্ছে কেউ একটা অঞ্চল ঘিরে দিয়েছে। কেন ? এখানেও জমি ভরাটের প্ল্যান? ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডের চৌবাগাতেও একই ছবি। কালিকাপুর ঝিলপাড় এলাকায় জলাভূমি ভরাট করে প্রচুর মানুষ বসবাস করছেন বলে অভিযোগ। তবে এখানকার বাসিন্দাদের অধিংকাংশের আসল বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন এলাকায়। পূর্ব কলকাতার এই ওয়েটল্যান্ড যে এখন বেআইনি নির্মাণের স্বর্গরাজ্য , তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকী কেউ কেউ তো বলেই ফেলছেন, নিজেরাই জলাজমি বুজিয়ে বাড়ি করেছেন। ১২ বছর ধরে তারা বাসও করছেন এখানে। আর এমন বসতি বেড়েই চলেছে। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বহুতলও। তাহলে কি কোনও একসময় আর জলাভূমি বলে কিছুই থাকবে না ? আর তা যদি না থাকে, তা কলকাতার বাস্তুতন্ত্রের পক্ষে কতটা মারাত্মক হলে পারে , তা বলাই বাহুল্য।