পূর্ব মেদিনীপুর: পূর্ব মেদিনীপুর (East Midnapore District) পশ্চিমবঙ্গের ২৩ টি প্রশাসনিক জেলার মধ্যে একটি। যা এর সদর দফতরটি তমলুকে অবস্থিত। চলুন এই জেলার ইতিহাস থেকে শুরু করে অর্থনীতি, রাজনীতি, পর্যটন-সহ অন্যান্য উল্লেখযোগ্য তথ্যগুলি একনজরে দেখে নেওয়া যাক।


 ইতিহাস


 ২০০২ সালে পয়লা জানুয়ারি অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার তমলুক, হলদিয়া, কাঁথি এবং এগরা নিয়ে পূ্র্ব মেদিনীপুর জেলা গঠিত হয়। কিছু পণ্ডিতের মতে তমলুক নামটি, সংস্কৃত শব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় লোককাহিনী অনুসারে তাম্রলিপ্ত নামটি মায়ুরা-ধজা (ময়ূর) রাজবংশের রাজা তাম্রধ্বজা থেকে এসেছে। সম্ভবত এই প্রাচীন রাজার তামার বিশাল বেস ছিল। এবং ধাতু তার সময়ে এই অঞ্চলে সমৃদ্ধি এনেছিল। সুতরাং তাম্রলিপ্ত এবং তমরধজা উভয়েরই নাম থেকেই এর উৎপত্তি হয়েছিল।


অবস্থান


পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর বিভাগের একটি জেলা। এই জেলার উত্তর পশ্চিম মেদিনীপুর ও হাওড়া জেলা। পূর্বদিকে রয়েছে হুগলি নদী এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং পশ্চিমে পশ্চিম মেদিনীপুর ও ওড়িশা।


ভূ-পরিচয়


পূর্ব মেদিনীপুর জেলা নিম্ন ভারত গাঙ্গেয় সমভূমি এবং পূর্ব উপকূলীয় সমভূমির একটি অংশ। টোগোগ্রাফিকভাবে জেলাটিকে দুটিভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত প্রায় পুরোপুরি সমতল সমভূমি পশ্চিম, পূর্ব এবং উত্তরে। দ্বিতীয়ত , দক্ষিণে উপকলূলীয় সমভূমি। জমির বিস্তৃত অঞ্চলটি পলি দিয়ে গঠিত। জেলার উচ্চতা সমুদ্র স্তর থেকে ১০ মিটারের মধ্যে।


রাজনীতি


পূর্ব মেদিনীপুরের সঙ্গে রাজ্যের রাজনীতিক ইতিহাস গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে। বিশেষ করে নন্দীগ্রাম গণহত্যা এই জেলার রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি অন্যতম কালো অধ্যায়। ২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সালেম গোষ্ঠীর জন্য সেজ গঠন করার উদ্দেশ্যে ১০ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করতে চাইলে, স্থানীয়রা প্রতিবাদে নামে। প্রশাসনিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে, গ্রামে ঢোকার রাস্তা কেটে দেন। এরপর এই প্রতিবাদ দমনের জন্য চার হাজারের বেশি একটি সশস্ত্র পুলিশের বাহিনী পাঠায়। ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় গ্রামবাসীদের সংঘাত বেধে গুলিবিদ্ধ হয়ে ১৪ জন গ্রামবাসী নিহত হন। আহত হন আরও ৭০ জন। এই দিনটি এখনও পালিত হয়। অপরদিকে, একুশের বিধানসভা নির্বাচনে এই জেলাতেই নজর ছিল সবার। কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারী, মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এই তিনজনেই  এই নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্র থেকেই ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। বরাবরের ভবানীপুরে দাঁড়ানো তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটের আগে মাস্টারস্ট্রোক দেন তিনি। দাঁড়ান শুভেন্দুর বিপরীতে। যদিও এই জেলার সমীকরণ বদলালেও তৃণমূলের উপর তা আঁচ পড়েনি। তৃতীয়বার সরকার গঠন করে ফের রাজ্য তৃণমূল সরকার। নাইবা আঁচ ফেলেছে উপনির্বাচনেও। পুনরায় নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দল কমিশনে বারবার জানিয়েও প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং মুখ্যমন্ত্রীর পদ অটুটই রয়ে গিয়েছে। কারণ শেষ হাসি হেসেছে ভবানীপুর। তবে একুশের ভোটে একমাত্র উল্লেখযোগ্য যা হয়েছে, তা হল বর্তমানে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা হয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী, আর তিনি এই জেলাতেই থাকেন। 


উল্লেখযোগ্য


 কৃষি ও শিল্পে এগিয়ে রয়েছে এই জেলা। এই জেলায় অবস্থিত হলদিয়া শিল্পাঞ্চল দেশের মধ্য়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চল। এই শিল্পাঞ্চলের প্রধান শিল্প হল পেট্রোকেমিক্যালস শিল্প। এখানে কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ-র যোগান পাওয়া যায়। হলদিয়ার ঝিকুরখালি গ্রামে ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার হলদিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এর পাশাপাশি তেল শোধন কেন্দ্র, সার শিল্প, কীটনাশক ওষুধ শিল্প , সাবান শিল্প, ফসফেট শিল্প, ক্লোরাইড ইন্ডিয়া লিমিটেড এর ব্যাটারি শিল্প, কার্বন ব্ল্যাক শিল্প , প্লাস্টিক, বেকারি এবং একাধিক কুটির শিল্প এগিয়ে চলেছে জেলাটিকে।


অর্থনীতি


২০০৬ সালে পঞ্চায়েতি রাজমন্ত্রক পূর্বমেদিনীপুরকে দেশের ২৫০টি পিছিয়ে পড়া জেলার মধ্যে (মোট ৬৮০ টি মধ্যে) অন্যতম নাম দিয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলীয় অনুদান তহবিল কর্মসূচির (বিআরজিএফ) তহবিল প্রাপ্ত পশ্চিমবঙ্গের ১১ টি জেলার মধ্যে এটি একটি।


যোগাযোগ ব্যবস্থা


সড়কপথে কলকাতা থেকে পূর্ব মেদিনীপুরের দূরত্ব প্রায় ৮৫.৭ কিমি। সড়কপথে কলকাতা থেকে NH ৬ অর্থাৎ মুম্বই -কলকাতা হাইওয়ের মাধ্যমে তিন ঘন্টা লাগবে পৌঁছতে। পাশপাশি হাওড়া থেকে ট্রেনে এলে, তাম্রলিপ্ত-সহ একাধিক ট্রেন পরিষেবা রয়েছে। 


পর্যটন


পূর্ব মেদিনীপুর ঘুরতে এলে  আপনি মন ভরে তাজা হাওয়া নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবেন। দিঘা পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সমুদ্র সৈকত শহর। আপনি এখানে সমুদ্রে চান করে আনন্দ পাবেন। মন্দারমণি হল কালিন্দি গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে বঙ্গোপসাগরের তীরে একটি ছোট সমুদ্র সৈকত। পাশাপাশি ছোট মৎস বন্দর। তবে এখানে অনেকেই সমুদ্র স্নান তেমন বিশেষ না করলেও দিঘার ভিড় এড়িয়ে সমুদ্রের স্বাদ নিতে যান। তমলুক পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা সদর। এটি রুপনারায়ণ নদীর তীরে অবস্থিত। এখানে ১১৫০ বছরের একটি প্রাচীন কালী মন্দির আছে। এটি ৫১ পিঠের মধ্যে একটি। পাশাপাশি এখানে পাঁশকুড়া ফুল চাষের জন্য বিখ্যাত পৌর শহর।দিঘা থেকে ১৪ কিমি পূর্বে রয়েছে এই শঙ্করপুর।দিঘার ঠিক ১৬ কিমি আগেই লুকিয়ে রয়েছে ভারতের অন্যতম সুন্দর এই সমুদ্রসৈকট।দিঘার ৪০ কিমি দূরে রয়েছে জুনপুত। রাজ্য সরকারের ফিশারি দফতর রয়েছে এখানে। আপনি এখান থেকেও ঘুরে আসতে পারেন।


আরও পড়ুন, কানে রক্ত ঝরা বন্ধ করতে এমসিল ! আঠা দিয়ে কান সিল করল হাতুড়ে


অন্যান্য


 ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই অঞ্চলের ভূমিকা অত্যন্ত উজ্জ্বল। যা এখনও সমানভাবে উচ্চারিত হয় সবার মুখে।  


 


তথ্য সূত্র- পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ওয়েবসাইট