কলকাতা: যাঁর কলমের ম্যাজিক ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। সময়ের প্রবহমানতাকে সাহিত্যরূপ দিয়ে যিনি পাঠকের মন জয় করেছেন প্রতিনিয়ত। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় যাঁর লেখা পড়ে বলেছিলেন 'ব্রাইট, বোল্ট, বেপরোয়া'। তিনি বিশিষ্ট সাহিত্যিক 'শংকর'। 


কাজ করতে গিয়ে ইংরেজ সাহেবের বড় নামে আপত্তি থাকায় মণিশংকর থেকে হয়েছিলেন শংকর। এর পর ১৯৫৩ সাল। ঠিক করলেন, চারপাশে যা ঘটছে, সেখান থেকেই উপাদান নিয়ে শুরু করবেন লেখালেখির। শংকরের বয়স তখন সবে ১৯-২০। শুরু হল শংকরের প্রথম বই ‘কত অজানারে’ লেখার কাজ।


সেরা বাঙালি ২০২২। আঠারোর সাবালক হওয়ার আত্মবিশ্বাসে ভর করে বাংলার কৃতি বাঙালিদের সম্মান জানিয়েছে এবিপি আনন্দ। সেই মঞ্চেই সেরার সেরা হিসেবে সম্মানিত সাহিত্যিক মণিশংকর মুখোপাধ্যায়। সেরা বাঙালির মঞ্চে তাঁর হাতে পুরষ্কার তুলে দেন সাহিত্যিক তথা আর এক সেরার সেরা বাঙালি শীর্ষেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। 


মঞ্চে এবিপি আনন্দর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সুমন দে-র প্রশ্নের উত্তরে ধরা পড়ে ছক-ভাঙা, অকপট সাহিত্যিকই। কোন 'রাবরি চূর্ণ'-র গুণে পৃথিবীর নানা কোণে পাঠককে এতদিন ধরে মজিয়ে রাখলেন তিনি? জানতে চাইলে শংকর মুখোপাধ্যায়ের উত্তর, শিব্রামবাবু হরলিক্স গুঁড়ো দিতেন, কিন্তু বলতেন কাউকে বলো না। তাহলে যদি দাম বেড়ে যায়! সেই ভয়ে সাহস পেতাম না কাউকে বলতে। একবার লন্ডন বইমেলায় আমার লেখা বেরিয়েছিল, গেছিলাম। ওখানে সাহেবরা জিজ্ঞেস করল, ইংরেজদের কাছে কি কিছুই শেখেননি? বলেছিলাম, হ্যাঁ শিখেছি তো কিন্তু পাবলিসিটি হয়ে যাবে বলে বলতে পারি না। অবাক হয়েছিলেন প্রশ্নকর্তা। 


মঞ্চে দাঁড়িয়ে এই রেশ রেখেই বলে গেলেন সাহিত্যিক। বললেন, আমার ছোটবেলায় সব হরলিক্স যুদ্ধে চলে গেল। তাও কোম্পানি বিজ্ঞাপন দিত মাঝে মাঝে। সেখানে বলা হত, এখন পাওয়া যাচ্ছে না, সবই যুদ্ধক্ষেত্রে চলে গেছে। তবে অপেক্ষা করতে হবে। একদিন ফিরে আসবে, ইট ইজ ওয়ার্থ ওয়েটিং ফর। 


আমারও হয়েছে তাই। অনেক দিন ধরে লিখছি, কেউ দেখে না, নজরও করে না, মানুষও মনে করে না, কেউ বলে টুকেছি এসব বলত। আমিও তখন দেখলাম হরলিক্সের বিজ্ঞাপনের মতোই এটাও ওয়েটিং ফর। এটা আমি আপনাদের থেকেই শিখেছি, ধৈর্য্য ধরে থাকলে কপালে জুটবেই। সাহিত্যিকের কথায়, আমি মনে মনে জানি আমার দর কতটুকু, তবু সেটুকুও ওয়েটিং ফর। 


মঞ্চে দাঁড়িয়ে সাহিত্যিককে ফের প্রশ্ন করলেন সুমন দে, 'শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় একবার নাকি আপনাকে বলেছিলেন, লেখক যখন লিখছেন, সেই লেখার প্রথম ৩০ পাতা পড়ার দায়িত্ব পাঠকের। তারপর সব থেকে লেখকের দায়িত্ব। পাঠকদের ধরে রাখতে লেখার কোন ফর্মুলা মেনে চলেন লেখক?  হাসতে হাসতে সাহিত্যিক শংকরের উত্তর, 'সত্যি কথা বলতে ওটা ভগবানই জুটিয়ে দেন। চেষ্টা করতে করতে কখন লেগে যায়। 


স্মৃতি হাতরে বলে চললেন সাহিত্যিক, 'শরদিন্দুবাবু আরও একটা কথা বলতেন- বাবা, যখন সময় থাকবে, তখন সময় নষ্ট কোরো না। অভিধান পড়বে, সেখানে থেকে যা পাবে তা আর কোনও লেখক বলবে না।  হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই দু- খণ্ড কিনেছিলাম, সেটা আমি আজও উল্টে যাই।  যখন আইডিয়া কমে যায়, হরিচরণ বাবুই আমাকে বাঁচিয়ে দেন। প্রতি পাতায় পাতায় গল্প। আপনাদের আশীর্বাদে তাই করে যাচ্ছি,কখনও লাগে, কখনও লাগে না।'


এ তো গেল মঞ্চের ওপরের কথা। মঞ্চ থেকে নেমে এবিপি লাইভের সামনেও ধরা দিলেন অকপট সাহিত্যিক। বললেন, ছোট বেলার কথা। পুরনো স্মৃতি টেনে মনে করলেন বাবা-মায়ের কথায়। বললেন, আমার প্রথম রচনা স্কুলের ম্যাগাজিনে প্রকাশ হওয়ার পর  বাবা বলেন,পাকামো না করে অঙ্কে মন দাও।


নিন্দা, তিরষ্কার, অবহেলা, এই নিয়েই লেখকের জীবন। তা জেনেই এই লাইনে ঢুকেছিলাম। যাঁরা সব জেনেও আমাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন তাঁদের কেউই আর ইহজগতে নেই তাঁদের সকলকে আমার প্রণাম।


ধৈর্য্য ধরে শাসনের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে মনের কথা শুনে, নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকে টানা পছন্দের কাজ করে যাওয়াটাই যে জীবনের আসল ম্যাজিক, সাফল্যের আসল রশদ, সেটাই যেন ফের একবার বাঙালিকে মনে করিয়ে দিয়ে গেলেন এবিপি আনন্দ ২০২২-এর সেরার সেরা বাঙালি মণিশংকর মুখোপাধ্য়ায়।