সোমনাথ মিত্র, হুগলি: সবুজে মোড়া স্নিগ্ধ গ্রাম। যদিও আধুনিকতার ছোঁয়ায় মেঠো লাল মাটির কাঁচা পথ বদলে গেছে কালো পাকা রাস্তায়। বর্ষার জলে মাঠ জুড়ে সবেমাত্র মাথা তুলতে শুরু করেছে ধান। শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে এমনই এক মাঠের মাঝখানে হঠাৎ যদি এক বিশাল সুপার ডিলাক্স বাস এসে দাঁড়ায়, তাহলে গ্রামবাসীরা অবাক তো হবেনই। একই অবস্থা হয় হুগলির দশঘড়া ২ পঞ্চায়েতের মাদপুর গ্রামের বাসিন্দাদের। কীসের বাস? কেন হঠাৎ মাঠের মাঝে দাঁড় করানো? প্রশ্ন জাগে সকলের মনেই। জানা যায়, বাসটি আদতে একটি সুসংহত শিশু বিকাশ কেন্দ্র।
ধনিয়াখালি ব্লকের দশঘড়া ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের মাদপুর ঘোষপাড়ায় বিগত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় এক প্রতিবেশীর জায়গায় একটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র চলত। সেখানে ১৮-২০ জন ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করত। যদিও এদের অনেকেই অনিয়মিত ছিল। পরবর্তীকালে গ্রামের সমস্ত ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের শিক্ষার আঙিনায় নিয়ে আসার জন্য চিন্তাভাবনা শুরু করে প্রশাসন। সেই থেকেই এমন এক স্কুল তৈরির কথা ভাবা হয় যেখানে প্রকৃতির কোলে পড়াশোনা শিখতে পারবে খুদেরা। দৌড়ে স্কুলে আসা হোক বা খেলার ছলে পড়াশোনা হোক। এর ফলে শিশু পড়ুয়াদের স্কুলের প্রতি আকর্ষণ বাড়বে বলে মনে করা হয়। সেই ভাবনা থেকেই এই প্রকল্পের সৃষ্টি। চতুর্দশ অর্থ কমিশন, MGNREGA এবং রাজ্যের অনগ্ৰসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের যৌথ উদ্যোগে প্রায় ১২ লক্ষ টাকা ব্যয়ে সবুজে মোড়া গ্ৰামের মাঝে বাসের আকৃতিতে তৈরি করা হয় এই শিশু বিকাশ কেন্দ্রটি ।
বাইরে থেকে ঝাঁ চকচকে রঙ করা বাস। সামনেটা কাচের আদলে তৈরি, চার চাকা, দুটো দরজা। বাসের দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে ভিতরে ঢুকলেই আরও অভিনব জিনিস চোখে পড়বে। 'বর্ণপরিচয়' থেকে শুরু করে নানা রঙের ফল,ফুল, কীটপতঙ্গ সহ বিভিন্ন মনিষীদের ছবি আঁকা বাসের দেওয়ালে। সিঁড়ির মতো ধাপ করে ১ থেকে ১০ পর্যন্ত নম্বর আঁকা রয়েছে, একইসঙ্গে ইংরেজি অক্ষরেও লেখা। শিশুদের সহজভাবে শেখানোর জন্য গোলাকার, অর্ধগোলাকার, বক্ররেখা, সরলরেখা, ত্রিভুজ ইত্যাদি নানা আকারের নাম সহ ছবি আঁকা হয়েছে। বিভিন্ন সব্জি ও মাছের ছবিও আঁকা হয়েছে নানা রঙে। ওজন মাপার জন্য ঝোলানো রয়েছে ওজন যন্ত্র। বাসের নিচের অংশে যেখানে বসে শিশুরা পড়াশুনা করবে সেটিও খুব সুন্দর ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সাজানো। বিশুদ্ধ পানীয় জল পেতে স্কুলের বাইরে বসানো হয়েছে জল তোলার আধুনিক মেশিন। এই 'বাস স্কুল'-এ এসে ছবির মাধ্যমে অনায়াসেই বাচ্চারা শিখতে পারবে সমস্ত পড়া।
সুদৃশ্য বাসে চড়তে পড়ুয়ার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে এই অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে। বর্তমানে প্রায় ৪০ জন পড়ুয়া রয়েছে এই কেন্দ্রটিতে। এমনকী আকর্ষিত হয়ে আশেপাশের গ্ৰামের থেকে স্কুল ছেড়ে এই স্কুলে আসতেও মরিয়া অনেকে। যে বাচ্চারা আগে স্কুলে না যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করত, তারাই এখন স্কুলে যেতে চেয়ে কান্নাকাটি করে।
বাস মডেল স্কুলের জনপ্রিয়তা এতটাই যে দশঘড়া ২ পঞ্চায়েতের প্রধান সঞ্জয় আহেরি বলেন, 'এলাকার বাইরে আশেপাশের ছেলেমেয়েরা বলছে আমরা বাস স্কুলে যাব, অন্য স্কুলে যাব না। ফলে আশেপাশের অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে পড়ুয়া কমে যাচ্ছে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের এই বাস কেন্দ্রটিতে আনার জন্য আবদার করছেন।'
কিন্তু কেন হঠাৎ এই ধরনের শিশু শিক্ষা কেন্দ্র তৈরি করা হল? এতে আর কি কোনও সুফল মিলেছে? ধনিয়াখালি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সৌমেন ঘোষ বলেন, ধনিয়াখালি ব্লকে ৫০০টি আই সি ডি এস স্কুল আছে। ছোট থেকেই শিশুদের মন বিকশিত করে তোলার লক্ষ্য সরকারের। তা সত্ত্বেও শিশু বিকাশ কেন্দ্রগুলিতে ভাটা চলছিল। সেই সঙ্গে, এই অঞ্চলে প্রচুর তফশিলি জাতি উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। অনেক সময় মা তাঁর সন্তানদের সঙ্গে করে কাজে নিয়ে চলে যায়। ফলে সেই সব বাচ্চারা আর স্কুলে আসে না। তাই খুদেদের লেখাপড়ায় আগ্ৰহ বাড়াতে ও আকর্ষিত করতে এই ধরনের মডেল স্কুলের চিন্তা ভাবনা করা হয়। প্রশাসনের সমস্ত আধিকারিকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তারপরই বাসের আদলে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র তৈরি করা হয়। প্রথম প্রচেষ্টাতেই অনেকটা সাফল্য এসেছে বলে মনে করছেন পঞ্চায়েত প্রধান। আশেপাশের অন্যান্য কেন্দ্রের থেকে এই কেন্দ্রে এখন পড়ুয়ার সংখ্যা অনেকটা বেশি বলে জানাচ্ছেন তিনি।
তবে করোনা অতিমারী থাবা বসিয়েছে শিশুদের আনন্দে। করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ সমস্ত স্কুলের পঠনপাঠন, ঘরবন্দি শিশুরা। মাদপুর গ্ৰামের স্থানীয় গৃহবধু মহুয়া দাস বলেন, 'বাস স্কুলের ভিতরে পাখি, ফুল,মাছ সব আঁকা দেখে বাচ্চারা খুব উৎসাহ পায়। কিন্তু এখন স্কুল বন্ধ। বাচ্চারা যেতে পারছে না। তাই তাদের মন খারাপ।'
দশঘড়ার মাদপুর গ্ৰামের এই মডেল সুসংহত শিশু বিকাশ কেন্দ্রের জনপ্রিয়তা দেখে আরও এই ধরনের মডেল স্কুল বানাতে উদ্যোগী স্থানীয় প্রশাসন। ধনিয়াখালি ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক সৌভিক ঘোষ বলেন, 'বাস মডেলের জনপ্রিয়তার পর "রেল ইঞ্জিন" মডেলে আরও একটি অঙ্গনওয়াড়ি স্কুল তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন'।