কমলকৃষ্ণ দে, পূর্ব বর্ধমান : ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে রয়েছে পূর্ব বর্ধমান জেলা। এই জেলার  বীর সন্তানদের মধ্য অন্যতম বটুকেশ্বর দত্ত। স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর ছিলেন এই বর্ধমানের যুবক। ভগৎ সিংহের হরিহর আত্মা ছিলেন তিনি । সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলি বিল্ডিংয়ে বোমা ছোড়ার ঘটনায় ভগৎ সিং-এর সহযোগী ছিলেন বটুকেশ্বর দত্ত  । বর্ধমানে বটুকেশ্বরের পাশের বাড়িটিই ছিল তাঁর বাল্য বন্ধু নগেন্দ্রনাথ ঘোষের। 


১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ভগৎ সিং, শিবরাম রাজগুরু অত্যাচারী ইংরেজ পুলিশ অফিসার জন স্যান্ডার্সকে হত্যা করেন।  তারপর  ভগৎ সিংকে ধরতে ইংরেজ পুলিশ শুরু করে চিরুনি তল্লাশি। তখন ব্রিটিশ পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে ভগৎ সিংকে ওঁয়াড়ি গ্রামে নিয়ে আসেন বটুকেশ্বর দত্ত। বটুকেশ্বরের পাশের বাড়ি নগেন্দ্রনাথের বাড়ির সুড়ঙ্গে গা ঢাকা দেন তিনি। 




নগেন্দ্রনাথের বাড়িতেই ১৮ দিন গা ঢাকা দিয়েছিলেন ভগৎ সিংহ । বাড়িতে বললে ভুল হবে, বলা ভাল বাড়ির সুড়ঙ্গে। ৯ ফুট  মতো লম্বা সেই সুড়ঙ্গ, যার অস্তিত্ব সম্পর্কে অনেকেই জানতেন না তখন। তাই সেখানে গা-ঢাকা দেওয়াটা সহজ ছিল। 


টানা কয়েক রাত তারা ওই সুড়ঙ্গ থেকে বের হননি। কারণ পুলিশ তখন পুরো ওঁয়াড়ি গ্রাম ঘিরে ফেলেছে এবং একাধিকবার তল্লাশিও করে ফেলেছে নগেন্দ্র নাথ ঘোষের বাড়ি। কিন্তু পুলিশ কীভাবে টের পাবে, আলমারির পাল্লার মতো জিনিসটির পিছনে রয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ড চেম্বার ?  ১৮ দিন পর দুজনে মহিলার ছদ্মবেশে বোঁয়াইচন্ডী স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরে পালায়। এই সুড়ঙ্গটি আজও আছে। তবে কেমন অবস্থায়, খুঁজে দেখল এবিপি আনন্দ। 


নগেন্দ্রনাথের বাড়িটি আজও আছে। চুন সুড়কির ঘর। ধ্বংসাবশেষের মতো পরিস্থিতি।  শেষের দিন গুণছে ভগৎ সিং, বটুকেশ্বর দত্তর স্মৃতি বিজড়িত সুড়ঙ্গটা।  আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই কোনও এক সময় ছিল এই ঘর, কিন্তু এখন তার অবস্থা ভয়াবহ। যে কোনও মুহূর্তে ধসে যেতে পারে ছাদ। খসে পড়ছে সিলিং। ধ্বংসের অপেক্ষায় দিন গুণছে ইতিহাস। এই বাড়িতে এখনও রয়েছে সুড়ঙ্গটা। ঝুঁকি নিয়ে নামাও যায়। তবে পর্যটকদের জন্য খোলা নয়, কারণ প্রতিমুহূর্তে ধসে পড়ার ভয়।  এই সুড়ঙ্গ থেকেই মহিলার ছদ্মবেশে ওঁয়াড়ি থেকে বটুকেশ্বর ও ভগৎ সিং  চলে যান দিল্লি। জানা যায়, সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলি বিল্ডিংয়ে বোমা ছোড়ার এই পরিকল্পনাটা হয়েছিল এই সুড়ঙ্গ থেকেই।  


ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে স্মৃতি আঁকড়ে রয়েছে সেই সুড়ঙ্গ। রাজ্য সরকার এই বাড়িটি সংরক্ষণ করার দায়িত্ব নিতে চেয়েছিল। এই বাড়ি ও বাড়ির সঙ্গে জড়িত ইতিহাসের সঙ্গে যাতে বর্তমান প্রজন্ম পরিচিত হয়, তাই তাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে চেয়েছিল সরকার। কিন্তু নগেন্দ্রনাথ ঘোষের পরিবার এই সুড়ঙ্গ সরকারের হাতে তুলে দিতে চায়নি। ১৯ শরিকের মতানৈক্যেই আজও অবহেলায় পড়ে  তাই বটুকেশ্বর দত্তর বসত বাড়িতেই  সুড়ঙ্গ তৈরী করা হয়েছে। এখন সেই সুড়ঙ্গ তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন সরকারের দেওয়া টাকায় আগেই বটুকেশ্বর দত্তের বাড়ির সংস্কার করা হয়েছিল। এখন তা দেখতে বহু মানুষের আনাগোনা হয়। তারপর রাজ্য নগেন্দ্র নাথ ঘোষের বাড়ির আদলে সুড়ঙ্গ ও বাড়ি তৈরি করছে। 




পূর্ব বর্ধমানের খণ্ডঘোষের ওঁয়াড়ি গ্রামে ১৯১০ সালের ১৮ই নভেম্বর এই গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেন বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্ত। বাবা কর্মসূত্রে কানপুরে থাকতেন। ছেলেবেলা সেখানেই কাটে বটুকেশ্বর দত্তের। ছাত্রজীবনেই জড়িয়ে পড়েন স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে। যোগদান করেন হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক অ্যাসোসিয়েশন বা এইচ এস আর এ সংগঠনে। সেখানেই বোমা বানানোর হাতে খড়ি হয় তাঁর।  পরে পরিচয় হয় বিপ্লবী ভগৎ সিংহের সঙ্গে। তরুণ বটুকেশ্বর  তখন দেশের জন্য কিছু করার জন্য উৎসাহে টগবগ করে ফুটছেন, তখনই  ব্রিটিশ সরকার সশস্ত্র বিপ্লব রুখতে ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া এক আইন চালু করার পরিকল্পনা করেন। এর বিরোধিতায় দিল্লিতে সংসদ ভবনে বোমা ছোড়ার পরিকল্পনা করা হয়। বোমা ছোড়ার দায়িত্ব পান দুজন। একজন ভগৎ সিং আর একজন বাংলার তরুণ বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্ত।  


বোমা মারার ঘটনায় ধরা পড়ে যান বটুকেশ্বর দত্ত। বিচারে ভগৎ সিং ও সুখদেবদের ফাঁসি হয়। বটুকেশ্বর দত্ত কে  আন্দামান সেলুলার জেলে দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়। যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে আন্দামান থেকে ফিরে আসেন বটুকেশ্বর দত্ত। গান্ধীজীর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দেন। এরপরও তার চার বছর কারাদণ্ড হয়। জেলবন্দি  থাকাকালীন অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ওপর নোংরা আচরণের বিরুদ্ধে ও রাজবন্দীর অধিকারের দাবিতে এক ঐতিহাসিক অনশনের উদ্যোগ শুরু করেন তিনি । 


দুঃখের বিষয় স্বাধীন ভারতে  বাঙালি বিপ্লবীকে আর কেউ সেভাবে মনে রাখেনি বলে অভিযোগ বটুকেশ্বর দত্তর পরিবারের লোকজন ও স্থানীয়দের । সরকারি সাহায্য বা সম্মান বিশেষ কিছুই পাননি তিনি । বাকি জীবন কেটেছিল নিদারুণ দারিদ্র্যে। জীবিকা নির্বাহের তাগিদে পরিবহণ সংক্রান্ত ব্যবসা করতেন।  ১৯৬৫ সালের ২০ জুলাই দিল্লির একটি হাসপাতালে লোক চক্ষুর অন্তরালে মৃত্যু হয় তার।


এখন রাজ্য সরকার বটুকেশ্বর দত্তের বসত বাড়িটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছে, সেখানে তৈরি করা হয়েছে অতিথি নিবাস। পাশাপাশি সংগ্রহশালাও। এছাড়াও স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির পক্ষ থেকে বারে বারে নগেন্দ্রনাথ ঘোষের পরিবারের সাথে কথা বললেও অনেকজন শরিক থাকায় বাড়িটি সংরক্ষণের দায়িত্ব নিতে পারেনি সরকার । বর্তমানে বাড়িটির অবস্থা অতি খারাপ।   যে কোনো সময় বাড়ির ছাদ ভেঙে পড়তে পারে মাথার উপর। সুরঙ্গের অবস্থাও খারাপ। এবিপি আনন্দের প্রতিনিধি  কোনওক্রমে সেই সুরঙ্গে প্রবেশ করেছিল, শুধুমাত্র ইতিহাসকে তুলে ধরার জন্য। যে কোনও দিন হয়ত ধসে পড়বে সুড়ঙ্গটি। 




রাজ্যের স্মৃতিসংরক্ষণ কমিটি  বটুকেশ্বর দত্তের বাড়ির চৌহদ্দিতেই নগেন্দ্রনাথ ঘোষের বাড়ির  আদলে একটি বাড়ি তৈরি করেছে।  তৈরি করেছে সুড়ঙ্গও, যার উদ্বোধন হওয়ার সম্ভাবনা বটুকেশ্বর দত্তের জন্মদিবসে।  নগেন্দ্র নাথ ঘোষের উত্তরসূরী সুপ্রসন্ন ঘোষ জানান,তাঁদের বাড়ি ব্যবহার করে বিপ্লবীরা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন, তার জন্য তিনি গর্বিত।


প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবসে প্রভাত ফেরি হয় ও পরে জাতীয় পতাকা  উত্তোলন করা হয়। বটুকেশ্বর দত্ত ও ভগত সিংহের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করার পাশাপাশি তাদের স্মৃতিচারণ করা হয় । মিষ্টিমুখ করানো হয় সকলকে। 


আরও পড়ুন 


যখন তখন বিপ্লবীদের নিয়ে হাজির হতেন স্বামী, নিজে না খেয়ে সকলের পেট ভরাতে হতো তাঁকে, সেই স্ত্রী কি স্বাধীনতা সংগ্রামী নন!