কলকাতা: একজন বিদেশে গিয়ে পড়েছেন বিপাকে। আর্থিক কষ্ট যখন মাথার উপর দিয়ে বইছে, তখন বাধ্য হয়ে দেশের একজনকে অর্থ সাহায্য চেয়ে চিঠি লিখে পাঠালেন তিনি। এদিকে যার উদ্দেশ্য়ে লেখা হয়েছে চিঠি, তিনি নিজেই ছোটবেলা থেকে আর্থিককষ্টে ভুগেছেন। কিন্তু তা বলে কি, বিদেশ বিভুঁয়ে পরমমিত্র বিপদে পড়েছে, এটাকি মেনে নেওয়া যায় ? চোখ ভিজে যায় অজান্তেই। ঋণ নিয়ে বিদেশে টাকা পাঠিয়ে মিত্রর পাশে দাঁড়ান দ্বিতীয়জন। পরম মিত্রর দুর্দিনে,পাশে দাঁড়াবার জন্য নিজের জীবনে আকণ্ঠ বিপদ ডেকে এনে নেওয়া, এই মানুষটিই হলেন ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (Ishwar Chandra Vidyasagar)। প্রথমজনকে নিশ্চয়ই চিনতে পারছেন ? মাইকেল মধুসূধন দত্ত (Michael Madhusudan Dutt)। সাধে সাধে তিনি লেখেননি..


বিদ্যাসাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু ! উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেম-ক্লান্তি অম্লান কিরণে।


'সিদ্ধান্ত'


সাল ১৮৫৬। সবে পরিচয় হয়েছে, বিদ্যাসাগরের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে মধুসূধন দত্তের। তাঁর লেখা 'তিলোত্তমাসম্ভব' কাব্যের মাধ্যমেই 'বর্ণ পরিচয়'-র সৃষ্টিকর্তার ঘনিষ্ঠতা শুরু। বলাইবাহুল্য বিদ্যাসাগর যে মধুসূধনের মাঝে মেধার সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়তে দেখেছিলেন, তারপর আর সাহায্যর হাত সরাননি। তারই অন্যতম নিদর্শন ১৮৬০ সালের গোড়ার দিকে টের পাওয়া যায়। ১৮৬২ সালের জুন মাসে তল্পিতল্পা গুছিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন মাইকেল। তখনও তিনি জানতেন না, একদিন 'মেধার' পাশাপাশি বড় প্রশ্ন তুলবে 'সিদ্ধান্ত।' এযনও অনেকটাই 'সময়'-র ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে ঠোঁটের কোণে হাসছে 'কাঁটা কম্পাস'। প্রশ্ন সেই, চিরাচরিত। যাবে কোন 'দিকে' ? বিদ্যাসাগরের সংস্পর্শের পর, তা ঠাহর করতে বেশি দেরি হয়নি মাইকেলের। তাই তো তিনি লিখে গেছেন...


সুখের লাগিয়ে এঘর বাঁধিনু, অনলে পুড়িয়া গেল,
অমিয় সাগরে সিনান করিতে সকলি গরল ভেল।


'দয়ার সাগর'


তেষট্টির মাঝামাঝি কবি মাইকেল মধুসূধন যখন লন্ডন থেকে প্যারিস সফর করছেন, সেসময়ই চরম আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্য়ে পড়েন তিনি। পকেট প্রায় শূন্য। ১৯৬৪ থেকে ৬৬ সালের মাঝে প্রায় ২১ চিঠি মাইকেলের থেকে পেয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। পরমমিত্রর চিঠি পেয়ে সেদিন আর বসে থাকতে পারেননি। ঋণ নিয়ে মাইকেলকে টাকা পাঠিয়েছিলেন 'দয়ার সাগর।' এখানেই ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একটা বড় উদাহরণ রেখে গিয়েছিলেন। নিজের আগে সমাজের জন্য ভাল করার এটাই হয়তো জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ।


যাক অন্ধকার, যাক সেই তমঃ
আলেয়ার মতো বুদ্ধির বিভ্রম।


'বোধোদয়'


তবে এঅবধি পড়ে মনে হতেই পারে, কাকে নিয়ে হচ্ছে কথা ? কী বিষয়ে রচনা ? কে উঠল গাছে ? ডিটেলিংয়ে আলতো ছোঁয়ায় প্রশ্ন জাগতে পারে মনে, কে অর্জুন ? কে কৃষ্ণ ? তাই বিদ্যাসাগরকে দেখতে গেলে শুধু তাঁর লেখা পড়ে নয়, বরং তাঁর সান্নিধ্য়ে আসা মানুষগুলির জীবন পড়লেও, প্রতিফলন ঠাহর করা যায়। আসলে এযেনও এক ধানি জমির আলপথ। যার মাঝে জল হয়ে প্রবেশ করে আজীবনকাল শস্যদানা ফুঁটিয়ে গিয়েছেন তিনি। মুখে কিছু না বলেই দেশ ও মানবজাতির 'বোধোদয়' করে গিয়েছেন এই একা মানুষটিই।


আড়ালে আড়ালে দেশে কীভাবে ছড়ানো আছে বিভীষিকা আর স্বেচ্ছাচার
তাঁকে তো বোঝাতে হবে এ এমন সময় বাঁচার।


বিধবা বিবাহ আইন


মধুসূধনের থেকে মাত্র ৪ বছরেরই বড় ছিলেন ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি জন্মেছিলেন বিট্রিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির বীরসিংহ গ্রামে। নিঃসন্দেহেই তাঁর কাছ থেকে সমাজ পেয়েছে, একটা বড় অভিজ্ঞতার গ্রাফ। তাঁর অন্যতম বড় অবদান নিয়ে আজও চর্চা করা হয়। তা হল নারী শিক্ষা এবং বিধবাবিবাহ আইন। ১৮৫৬ সালে সরকার বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ ঘোষণা করেন। বিষয় কাকতালীয় হলেও ঠিক এই সময়ের আশেপাশেই মধুসূধন দত্তের সঙ্গে এই 'সমাজ সংস্কারকের' পরিচয়। দেখতে দেখতে আজ অনেকগুলি বছর পেরিয়ে গিয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী বিদায়ের পথে। তবে জুলাইয়ের শেষে  যতই তাঁর মৃত্যু বার্ষিকী আসুক না কেন, আজও কোটি কোটি মানুষের চেতনায় রয়ে গিয়েছেন তিনিই। 


তারপর যুগের পর যুগ ধরে
লগি ঠেলতে ঠেলতে আসছি তো আসছিই, আসছি তো আসছিই
তা আর শেষ হয় না-


প্রতীক্ষায় পথে পড়ে আছে সুপুরিগাছের ভাঙা ডাল, পানপাতা, ঝুমকো জবা
উবু হয়ে দাওয়ায় বসা ঠাকুমা
হাতে একটা বাঁকা লাঠি, চোখে ঘোলাকাচের চশমা-


আর লগি ঠেলে ঠেলে
আসছি তো আসছিই, আসছি আমি...


আরও পড়ুন, '..এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না', শেষ জীবনে এখানে বারবার ফিরেছেন 'নবারুণ'


ঋণ: মাইকেল মধুসূধন দত্ত, স্বামী বিবেকানন্দ (জ্ঞানযোগ-সন্ন্যাসীর গীতি), শঙ্খ ঘোষ (শুনি শুধু নীরব চিৎকার), ডকুমেন্টারি (রাজ্যসভা টিভি)