কলকাতা : দেশের অসহায়, আর্ত মানুষের বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ানোর, ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রবণতা ছিল সেই ছোট থেকেই। তাঁর জীবনের এই মুহূর্তটি তো অনেকেরই জানা - ছোটবেলায় একবার খুব শীতে এক ভিখিরি এসে দাঁড়িয়েছেন দুয়ারে। গায়ে ছেঁড়া শাল। প্রবল ঠাণ্ডায় জীর্ণ-শীর্ণ ভিখিরির আরও করুণ দশা। অথচ তাঁকে দেওয়ার মতো কিছুই ছিল না কিশোর ক্ষুদিরামের। ছিল কেবল প্রয়াত বাবা ত্রৈলোক্যনাথের শেষ স্মৃতিচিহ্ন বলতে, একটি শাল। সাতপাঁচ না ভেবে সেই শাল ভিখিরিকে দিয়ে দেন ক্ষুদিরাম। বলেন, “বাবার শেষ স্মৃতি তোমার হাতে তুলে দিলাম, কারণ এর থেকে যোগ্য পাত্র আর কোথায় বা মিলবে ! তোমাকে দেওয়ার মত আমার আর কিছুই নেই। এই শাল আমি গায়ে দিইনি, গায়ে দেওয়ার মত সুযোগ আমার আসবে কি না সন্দেহ। ” এই কাজে দিদি অপরূপাদেবী প্রতিবাদ করে বলেন, ভিখিরি কি শাল গায়ে দেবে ! ও তো বিক্রি করে ফেলবে। তার উত্তরে ক্ষুদিরাম বলেছিলেন, “জানি তো বিক্রি করে ফেলবে। বিক্রি করে যা পাবে, তাতে ওর কিছুদিন পেট তো চলবে। বাবার স্মৃতি, বাক্সে পড়ে থেকে পচে যাওয়ার চেয়ে কারও একমুঠো অন্নের সংস্থান হলে, বাবার জিনিসটিরও সার্থক হল।” 

এই ছিলেন ক্ষুদিরাম। ক্ষুদিরাম বসু। যে দৃপ্ত, দৃঢ়চেতা কিশোর অকালে গলায় হেলায় পরে নিতে পারেন ফাঁসির দড়ি, তাঁর জীবন, স্বল্প-জীবনের পাহাড়স্বরূপ কার্যকলাপ আমাদের প্রেরণা জুগিয়ে চলে আজও।

ছোট থেকেই বড় ঘটনাবহুল ছিল তাঁর জীবন। চেহারা রোগাটে গড়নের হলে কী হবে, ছিল সিংহের হৃদয়। ১৯০৬ সাল তখন। গোটা দেশে স্বদেশি আন্দোলনের ঢেউ। দেশের কাজ ছাড়া কিছুই তখন দেখতে পেতেন না ক্ষুদিরাম বসু। ইংরেজদের বলতেন ‘সাদা পঙ্গপাল’। মেদিনীপুরের পুরাতন জেলের মাঠে বসেছিল কৃষি-শিল্প প্রদর্শনী। ব্যায়াম শিক্ষক রামচন্দ্র সেন এবং মন্ত্রগুরু সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নির্দেশে গুপ্ত সমিতির হয়ে ‘সোনার বাংলা’ নামে লিফলেট বিলির দায়িত্ব পান ক্ষুদিরাম বসু। বাধা দেয় ইংরেজ পুলিশ। তাঁকে ধরতে গেলে সপাট ঘুষি চালান ক্ষুদিরাম। এলাকা থেকে চলে যান দ্রুত। জারি হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা। পরে অবশ্য আত্মসমর্পণ করেছিলেন তিনি। শুরু হয়েছিল রাজদ্রোহের মামলা। 

ক্ষুদিরাম বসুর পক্ষের আইনজীবী যখন তাঁর হয়ে জামিনের জন্য আবেদন করেছিলেন, তখন নাকি বীর ক্ষুদিরাম তাঁকে বলেন, …” শাস্তি এড়াতে চাই না। আমি চাই, ওরা জেলে পুরুক। ফাঁসিতে না ঝুললে দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করব কী করে।"

আদালতে সওয়াল-জবাব চলার সময় বারংবার তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, কার নির্দেশে পুস্তিকা তিনি বিলি করছিলেন ? কিন্তু না, হাজার প্রশ্নে, হাজার চাপের কাছে নত হয়ে গিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম তিনি বলেননি। আদালত কক্ষে হাজির থাকলেও দেখিয়ে দেননি। বয়স কম হওয়ায় এবং নিজের বুদ্ধিতে কাজ করেননি- এ ধারণার জেরে কোনও শাস্তি সেবার হয়নি ক্ষুদিরাম বসুর। তবে বীরের সম্বর্ধনা সেদিন পেয়েছিলেন তিনি। মেদিনীপুরের মাটিতে দাঁড়িয়ে বাংলার বীর এই সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন শ্রী অরবিন্দ।

যত দিন গিয়েছে, আরও বেড়েছে তাঁর বীরত্ব। ‘সাদা পঙ্গপাল’দের ভারতের মাটি থেকে বিনাশ না করে যেন তাঁর শান্তি ছিল না। ১৯০৭ সাল নাগাদ আবার এক কৃষি-শিল্প প্রদর্শনীর মাঠে নিষেধাজ্ঞা ছিল ‘বন্দেমাতরম’ বলার উপরে। তার প্রতিবাদে তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট ওয়েস্টন সাহেবের সামনেই বন্দেমাতরম আওয়াজ উঠেছিল গোটা মেলার মাঠে। পুলিশের বেতের বাড়িতে ফালাফালা হয়ে গিয়েছিল পিঠ। 

সংক্ষেপে কিংসফোর্ড পর্ব

অত্যাচারী ডগলাস কিংসফোর্ড তখন কলকাতায়। চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট। দিনের পর দিন দেশের সাধারণ মানুষ থেকে বিপ্লবী, বিচারের নামে প্রহসন করে, অমানবিক অত্যাচারের মুখে ঠেলে দিয়ে ঘৃণার পাত্র হয়ে গিয়েছিল সে। পনেরো বছরের কিশোর সুশীল সেনকে একবার যত বয়স তত বেতের ঘা পিঠে মারার নির্দেশ দিয়েছিল। এরকমই আরও অত্যাচারের নজিরে কিংসফোর্ড নিজেকেই ছাড়িয়ে যাচ্ছিল দিনের পর দিন। একবার বইবোমা পাঠিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তাকে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সুশীল সেনকে। পরে প্রফুল্ল কুমার চাকিকে। উনিশ বছরের সদ্য কৈশোর পেরোনো প্রফুল্ল চাকি তখন নানা বিপ্লবী কার্যকলাপের উজ্জ্বল মুখ। বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষ নির্বাচন করছিলেন তাঁর প্রিয় এই শিষ্যকে অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে শাস্তি দেওয়ার জন্য়। এ কাজে একজন সঙ্গী দরকার। কে হবে প্রফুল্ল চাকির সঙ্গী ? হেমচন্দ্র কানুনগোর মনে পড়ল ক্ষুদিরাম বসুর কথা। ক্ষুদিরাম তখন মেদিনীপুরে। কলকাতার গুপ্ত সমিতি থেকে ডাক এল তাঁর কাছে। ১৯০৮-এর ১৮ এপ্রিল বাড়ি থেকে শেষবারের মত রওনা হলে ক্ষুদিরাম। 

ততদিনে কিংসফোর্ড বদলি হয়ে গিয়েছে বিহারের মজঃফরপুরে। জেলা জজ। স্থান বদলালেও বদলায়নি তার অত্যাচারের ধরন আর বিচারের নামে প্রহসন। এদিকে, কলকাতার মানিকতলায় গোপন জায়গায় দেখা হল প্রফুল্ল চাকি আর ক্ষুদিরাম বসুর। কেউ জানলেন না কারও আসল নামধাম। প্রফুল্ল চাকি হলেন দীনেশ রায়। আর ক্ষুদিরাম হলেন দুর্গাদাস সেন। সপ্তাহখানেকের প্রশিক্ষণ, বোঝাপড়া আর তারপর কোনও সন্ধ্যার অন্ধকারে মজঃফফরপুর যাত্রা। সঙ্গে কিংসফোর্ডের মারণবোমা। সঙ্গে লোডেড রিভলভার। 

মজঃফরপুরে গিয়ে ধর্মশালায় আশ্রয় নিয়ে রেকি করলেন। এলাকা চিনলেন। ৩০ এপ্রিল, ১৯০৮। ততক্ষণে দুই বিপ্লবীর জানা হয়ে গিয়েছে স্থানীয় ইউরোপিয়ান ক্লাবে ঘোড়ায় টানা গাড়ি চড়ে যায় কিংসফোর্ড। অতএব… সেই সুযোগকেই কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত। গাছের আড়ালে এক সন্ধেয় অন্ধকার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলেন এক কিশোর আর এক তরুণ। কিংসফোর্ডের অপেক্ষায়। তারপর দেখা গেল সেই গাড়ি। দক্ষ শিকারির মত আপাত শান্ত অথচ ভিতরে ক্ষিপ্র হয়ে উঠলেন দু'জন। গাড়ি কাছাকাছি আসতেই অভ্রান্ত নিশানায় ছুড়লেন বোমা। মুহূর্তে বিস্ফোরণ। তখনও তাঁরা জানতেই পারলেন না, তাঁদের টার্গেট কিংসফোর্ড নয়, ওই গাড়িতে ছিলেন জনৈক প্রিঙ্গল কেনেডির স্ত্রী ও কন্যা। মিসেস  ও মিস কেনেডি। 

রাস্তা আলাদা হয়ে গেল দুজনের। সোজা রেললাইন ধরে ছুটতে লাগলেন ক্ষুদিরাম। উলটোদিকে প্রফুল্ল চাকি। খবর তখন ছড়িয়ে পড়েছে আগুনের মত। অন্ধকার চিরে ফেলছে পুলিশের ভারী বুটের শব্দ। পুরস্কার ঘোষণা করে হয়েছে ‘আততায়ীদের’ ধরতে। 

গ্রেফতারি

আলো ফুটছে তখন। ক্ষতবিক্ষত পায়ে দৌড়ে ক্ষুদিরাম পৌঁছলেন একটি স্টেশনে। ওয়াইনি। ক্লান্ত, শ্রান্ত। খিদে-তেষ্টায় কাতর ক্ষুদিরাম তখন স্টেশন লাগোয়া বাজারে কিছু খাবার কেনার জন্য গেলেন। এক গ্লাস জল যখন দোকানে চাইছেন তিনি… পুলিশের চোখ ধেয়ে গেল তাঁর দিকে। কোথা থেকে আসছ ? যাবে কোথায় ? পুলিশের এই প্রশ্নের উত্তরে ধোঁয়াশা রেখেও ধরা পড়ে যান।  না, রিভলভার বার করার সুযোগ পাননি। হাতে পড়ে হাতকড়া। উদ্ধার হয়, ৩৭টি টোটা। প্রায় ৩১ টাকা। টাইম টেবিলের ছেঁড়া পাতা আর ট্রেনের একটি ম্যাপ।     

পরে বিকেলের ট্রেনে মজঃফরপুর নিয়ে যাওয়া হয় বীর ক্ষুদিরামকে। স্টেশনের বাইরে থিকথিকে ভিড়। তাঁদের দিকে চেয়ে ক্ষুদিরাম আওয়াজ তোলেন ‘’বন্দেমাতরম।"

 

বন্দী অবস্থায় ক্ষুদিরাম বসু

ক্ষুদিরাম ধরা পড়েছেন তা তখনও জানতেন না প্রফুল্ল চাকি। তিনি তখন ধরেছেন কলকাতা যাওয়ার অন্য ট্রেন। তবে ধরা পড়ে যান ট্রেনের কামরায় থাকা পুলিশ অফিসার নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। আসলে ধরা দেননি তিনি। মোকামাঘাট স্টেশনে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে দেখে গুলি চালান নিজের বুকে, চিবুকে। লুটিয়ে পড়েন। 

বিচারপর্ব

অন্যদিকে, ১৯০৮ সালের ১ মে ধরা পড়ার পর বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় ক্ষুদিরাম বসুর। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট উডম্যানের এজলাসে। স্বীকারোক্তি নেওয়া হয় বীর-কিশোরের। সঙ্গহীন। পরে ম্যাজিস্ট্রেট বার্থউডের এজলাসে শুরু হয়ে বিচার। স্থানীয় কালীদাস বসু ,উপেন্দ্রনাথ সেন ক্ষুদিরাম বসুর আইনজীবী হিসেবে লড়েন। পরে সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী সহ আরও কয়েকজন যোগ দেন।   

শেষ দফায় বিচার শুরু হয় বাঁকিপুরের অতিরিক্ত দায়রা জজ কর্নডফের এজলাসে। ১৯০৮ সালের ৮ জুন থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত। নানা সওয়াল-জবাব শেষে ক্ষুদিরাম বসুকে বাঁচানোর চেষ্টা বিফল হয় আসামী পক্ষের আইনজীবীদের। বিচারকের রায়… “এসেসরগণের সঙ্গে একমত হয়ে হত্যার অপরাধে আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করে তাকে প্রাণদণ্ডের আদেশ দিলাম।” 

তবে তা শুনেও নির্বিকার ক্ষুদিরাম। তিনি রায় বুঝতে পেরেছেন কি না জিজ্ঞাসা করে বিচারক। ইতিবাচক উত্তর দেন ক্ষুদিরাম। বিচারকের ফের জিজ্ঞাসা, তিনি কিছু বলতে চান কি না। ক্ষুদিরামের দৃপ্ত উত্তর ছিল - “আমাকে একটু সময় দিলে বোমা তৈরির কৌশল শিখিয়ে দিতে পারি। ” তাজ্জব হয়ে যান এজলাসের সকলে। 

আপিল করার সুযোগ থাকলেও করেননি ক্ষুদিরাম বসু। তবে পরে নানা চেষ্টায় ও বিপ্লবীদের হস্তক্ষেপে আপিল প্রক্রিয়া জারি হয় এবং আপিল করা হয় হাইকোর্টে। ৮ জুলাই শুনানি শুরু হয় হাইকোর্টে। ক্ষুদিরাম বসুর পক্ষে সওয়াল করেন নরেন্দ্রকুমার বসু। চেষ্টা করেন আপ্রাণ। শুনানি শেষে ঠিক হয়, ১৩ জুলাই রায় দেবে হাইকোর্ট। 

শ্বেতাঙ্গ বিচারক। তাই বিচারের নামে প্রহসন যে হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখেনি। আপিল খারিজ করে ক্ষুদিরামের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে দুই বিচারপতি। 

ক্ষুদিরাম বসুকে বাঁচিয়ে রাখার সাহস ইংরেজ দেখাতে পারেনি। যে চার শেষ ইচ্ছের কথা জানিয়েছিলেন ক্ষুদিরাম, অত্যাচারী ইংরেজ তার তিনটি পূরণ হতে দেয়নি। দেখা করতে দেওয়া হয়নি দিদি অপরূপার সঙ্গে।

মজঃফরপুরের জেল। ১৯০৮ সালের ১১ অগাস্ট। মঙ্গলবার। ভোর ছটায় ফাঁসি। আগের রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি উপেন্দ্রনাথ সেন ও ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাঁসির সময় উপস্থিত থাকতে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল এই দুই আইনজীবীকে। “নিকটবর্তী রাস্তা লোকে-লোকারণ্য। ফুল লইয়া অনেকে দাঁড়াইয়া আছে”, লিখেছিলেন বেঙ্গলি পত্রিকার সংবাদদাতা আইনজীবী উপেন্দ্রনাথ সেন। তিনি আরও লিখেছেন…”একটু অগ্রসর হইতেই দেখিলাম, ক্ষুদিরামকে লইয়া আসিতেছে চারজন পুলিশ। ক্ষুদিরামই আগে আগে দ্রুত পদে অগ্রসর হইয়া, যেন সিপাহীদের টানিয়া আনিতেছে। আমাদের দেখিয়া একটু হাসিল… ” 

তারপর ছটা বাজল। গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় অন্ধকার পাটাতনের নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল পরাধীন ভারতকে স্বাধীনতা দিতে চাওয়া এক সূর্য-আলোকচ্ছটা। হাসিমুখে। ক্ষুদিরামের জীবনদীপ নিভে গেল বটে, কিন্তু যে আগুন তিনি হাজার হাজার প্রাণে জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, তার প্রবল লেলিহান শিখায় দগ্ধ হয়ে গিয়েছিল ইংরেজ শাসক, ইংরেজ শাসন। বন্দেমাতরম। 

তথ্যঋণ - ক্ষুদিরাম (সম্পাদনা মানিক মুখোপাধ্যায়, শৈলেশ দে, সৌমেন বসু)

ফাঁসি ও কারাবাসে বিপ্লবীরা - চিন্ময় চৌধুরী

ক্ষুদিরামের ফাঁসি - সুনীল জানা

অন্যান্য পত্রপত্রিকা