অভিজিৎ চৌধুরী, মালদা: এতটুকু বয়সে অচেনা পরিবেশে এসে ওঠা। সমাজ সংসারের জটিলতা কিছুই বুঝতেন না। শুধু সঙ্গের মানুষটিকে দেখে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পেয়েছিলেন। তার পর কত কত যুগ পার হয়ে গিয়েছে। সেই অচেনা পরিবেশই এখন নিশ্চিন্ত আশ্রয়। কিন্তু জীবনের নব্বইটি বছর পার করেও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না নমিতা ভট্টাচার্য এবং গীতা ভট্টাচার্য। সমাজের মতিগতিই ভাল ঠেকছে না তাঁদের। তাই হারিয়ে যাওয়া অতীত নয়, আসন্ন ভবিষ্যৎ ভাবি তুলছে তাঁদের। সেই সঙ্গে আক্ষেপ ঝরে পড়ছে গলা থেকে। এই স্বাধীনতার জন্যই এত লড়াই, স্বগতোক্তি করতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন দু’জনেই (Independence Day 2022)। 


সঠিক অর্থে শহর হয়ে না উঠলেও, মালদার (Malda News) হরিশচন্দ্রপুরের (Harishchandrapur) রাস্তাঘাটে শহুরে ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। মানুষজনের চেয়ে টোটো, অটো, লরি, ম্যাটাডোরই চোখে পড়ে বেশি। রাস্তায় বেরোলে পাশের জনের কথা শোনা যায় না। তার মধ্যে পুরোপুরি শহুরে হয়ে ওঠা হয়নি একটি বাড়ির। নিঃশ্বাস বন্ধ করে কোনও রকমে গজিয়ে ওঠা নয়, গাছগাছালির মধ্যে হাত পা ছড়িয়ে বসে রয়েছে একটি বাড়ি। কংক্রিটের শহরে একটুকরো সবুজের মতোই। তবে ইট-সিমেন্টে গাঁথা হলেও, বাড়ির দেওয়ালের পরতে পরতে রয়েছে ইতিহাসের ছোঁয়া। দুই প্রবীণা মুখোমুখি হলেই ফিরে পায় প্রাণশক্তি। কিন্তু স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তিতে দেশ জুড়ে যখন পালিত হচ্ছে অমৃত মহোৎসব, সেই সময় ইতিহাসের পরত ছাপিয়ে উঠে আসছে শুধুই দীর্ঘশ্বাস। 


স্বাধীনতার ‘অমৃতকাল’ উদ্‌যাপিত হলেও, মন শুধুই হতাশ


বিষ্ণুব্রত ভট্টাচার্য এবং শ্রীসুন্দর ভট্টাচার্য। সম্পর্কে খুড়তুতো ভাই। কবিগুরুর স্নেহধন্য দেশিকোত্তম বিধুশেখর শাস্ত্রীর দুই ভ্রাতুষ্পুত্র। তাঁদের নাম শোনেননি, এমন লোক নেই হরিশচন্দ্রপুরে। স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি রয়েছে এলাকায়। শৃঙ্খল ভেঙে তখন মুক্তির স্বপ্ন দেখছে গোটা দেশ। দেশের হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ তরুণের মতো, তাঁদের রক্তও তখন ফুটছে। ভবিষ্যতের পরোয়া না করে তাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ভারত ছাড়ো আন্দোলনে। তার জন্য জেলও খাটতে হয়েছিল দুই ভাইকে। সেই অভিজ্ঞতাই আরও নিবিড় করেছিল তাঁদের সম্পর্ক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও সমাজ-সংসারের জন্যই আজীবন খেটে গিয়েছেন। ‘অমৃতকাল’ দেখার জন্য বেঁচে নেই তাঁরা। কিন্তু রয়েছেন তাঁরে সহিধর্মিনীরা। কিন্তু প্রিয়জনের আত্মত্যাগের হিসেব করতে গিয়ে আক্ষেপ না করে পারছেন না তাঁরা। 




স্বাধীনতা সংগ্রামী বিষ্ণুব্রত ভট্টাচার্য এবং শ্রীসুন্দর ভট্টাচার্য।


বিষ্ণুব্রত ভট্টাচার্যের স্ত্রী নমিতাদেবী। ২১ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে হরিশচন্দ্রপুরে পদার্পণ। স্বাধীনতা সংগ্রামী স্বামী শুধু জীবনসঙ্গীই নয়, অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিলেন তাঁর কাছে। কলকাতায় তো বটেই, তার বাইরেও একাধিক স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন বিষ্ণুব্রতবাবু। রাজ্যে হেডমাস্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিও ছিলেন একসময়। নির্বাচনী রাজনীতিতেও অংশ নিয়েছিলেন। মালদা জেলার শিক্ষা ব্যবস্থায় তাঁর অবদান অস্বীকার করতে পারেন না কেউ। কাছ থেকে স্বামীর সেই লড়াই দেখেছিলেন নমিতাদেবী। কিন্তু ২০২২-এ পৌঁছে আক্ষেপের সুর ধরা পড়ে তাঁর গলায়। জানান, স্বাধীনতা পরবর্তী দেশ এবং রাজ্যের অবস্থা দেখে খুব দুঃখ হয়। আমৃত্যু যে শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য লড়াই করে গিয়েছেন তাঁর স্বামী, আজ দুর্নীতির বাসা গড়ে উঠেছে তার অন্দরে। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বসে গিয়েছে দুর্নীতি, যা শুধু সমাজ-সংসারের নয়, তাঁদের লড়াইয়ের জন্যও অত্যন্ত লজ্জাজনক। 


তাই নমিতাদেবী বলেন, ‘‘মানুষের বিত্ত হতে চিত্ত বড়, এই ভারতের মর্মবাণী। দেশের উপকার, মানুষের উপকার কী করব, সারাক্ষণ সেই চিন্তাই ছিল আমাদের স্বামীদের। স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্ত্রী এবং ভারতবাসী হিসেবে গর্ববোধ করি। দেশের খারাপ করতে চায় যারা, তাদের পছন্দ করি নাআমরা। হরিশচন্দ্রপুরে এতদিন আছি। আন্দোলন হচ্ছে, অথচ রাস্তাঘাট খালি। বাইরে গিয়ে কফিনবন্দি হয়ে ফিরছে মানুষের দেহ। কেন? এর উত্তর চাই আমরা। দেশকে অবনত হতে দিতে চাই না। স্বাধীনতা সংগ্রামীর পরিবার হিসেবে এটাই আবেদের আবেদন, নিবেদন।’’


স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে এই পরিণাম!


আক্ষেপ কম নেই গীতাদেবীরও। বাপের বাড়ি ছিল বাংলাদেশে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে শ্রীসুন্দরবাবুর সঙ্গে বিয়ে হয়ে হরিশচন্দ্রপুরে এসে ওঠা। তখন সবে স্বাধীন হয়েছে দেশ। স্বামী ছিলেন গাঁধীবাদী আদর্শে দীক্ষিত। সেই সময় শ্রীসুন্দরবাবুর সঙ্গে দেখা করতে তথআকথিত নিম্নবর্গের মানুষজন বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতেন। সপ্তাহে একদিন অন্তত বাড়ির উঠোনে খাওয়াদাওয়ার বিশেষ আয়োজন হতো। সেখানে গৃহসহায়কদের সঙ্গে বসে দুপুরে পাতপেড়ে খেতেন শ্রীসুন্দরবাবু। মহাত্মা গাঁধীর অস্পৃশ্যতা বিরোদী আন্দোলন ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়েছিল শ্রীসুন্দরবাবুকে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে হরিশচন্দ্রপুর থানার সামনের কালী মন্দিরের ভোগ রান্না করিয়েছিলেন হরিজনদের দিয়ে। আজও সেই রীতি চলে আসছে। 


স্বাধীনপ্রাপ্তির পর রেলে চাকরি পেয়েছিলেন শ্রীসুন্দরবাবু। স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে তৎকালীন সরকারের তরফে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাও দেওয়া হয়। কিন্তু চাকরি গ্রহণ করলেও, সুযোগ সুবিধা সব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। একান্তে স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন, দেশের স্বাধীনতার বিনিময়ে অতিরিক্ত কোনও সুবিধা চান না তিনি। কিন্তু বেঁচে থাকলে এই স্বাধীন দেশের এই ছবি হয়ত চোখে দেখতে পারতেন না শ্রীসুন্দরবাবু, মনে করেন গীতাদেবী। জানিয়েছেন, ধর্মান্ধতার বেড়াজালে আবদ্ধ দেশ। হানাহানি চলছে নিয়ত। স্বাধীন দেশ এমন হোক, কখনওই চাননি তাঁদের স্বামীরা। তিনি বলেন, ‘‘কতলোক জীবন দিয়েছেন দেশ স্বাধীন করতে। এখন যা হচ্ছে, ভাবতেই খারাপ লাগে। কী অবস্থা হয়েছে দেশের! টাকাপয়সা তছরুপ করে দেশটাকে শেষ করে দিচ্ছে। আজ কেউ দেশের ভাল চিন্তা করে!’’


একসঙ্গে বসে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তাই হতাশ হতে দেখা যায় নমিতাদেবী এবং গীতাদেবীকে। জানান, যে উদ্দেশ্য নিয়ে দেশকে স্বাধীন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাঁদের স্বামীরা, বেঁচে থাকলে আজকের পরিস্থিতি দেখে লজ্জাবোধ হতো তাঁদের। 


আরও পড়ুন: Cattle Scam: 'অনুব্রত-র ছায়াসঙ্গী ছিলেন অনুপম', খোঁচা জয়প্রকাশের