কলকাতা: বাংলার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান মালদা। মসজিদ-মন্দির থেকে চার্চ সর্বধর্মসমন্বয়ের নির্দশনও এই জেলা। তাছাড়া যদি রসনা তৃপ্তির কথা ধরা যায়, তাহলে ফলের রাজা আমের কথা উঠে আসবেই। এছাড়া, মালদার মূল শহর গৌড়। যাকে রাজধানী করেই শশাঙ্কের আমলে আদি বাংলার ইতিহাস আবর্তিত হয়েছে। এছাড়াও চাল-ডাল-পাট-তৈলবীজ উৎপাদনেও এই জেলার নিজস্ব স্বতন্ত্রতা রয়েছে। 


বর্ষবরণের সময়ে যদি উইকেন্ডে কোথাও যেতে চান, তাহলে শীতের মিঠে রোদ উপভোগ করতে চলে যেতেই পারেন মালদায়। দর্শনীয় স্থান প্রচুর। আর ইতিহাসের প্রতি যদি বিশেষ ভালবাসা থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। এ জায়গার মাহাত্ম্য আলাদা করে বোঝানোর দরকারই নেই। 


এবার এক নজরে দেখে নেওয়া যাক, কোন কোন জায়গা ঘোরার তালিকায় রাখতে পারেন- 


গৌড়


মালদার অন্যতম দর্শনীয় স্থান এটি। রাজা শশাঙ্ক প্রথমে গৌড়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। গৌড় বাংলার এককালীন রাজধানী এবং অধুনা ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি স্থান।  সেন সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের আগে গৌড় অঞ্চলটি পাল সাম্রাজ্যের অধীনের ছিল এবং সম্ভবতঃ রাজা শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ ছিল এর প্রশাসনিক কেন্দ্র। 


বড় সোনা মসজিদ


বড় সোনা মসজিদ বা বারো দুয়ারী গৌড়ের স্থাপত্য কীর্তিগুলির মধ্যে অন্যতম। এর উচ্চতা ২০ ফুট, দৈর্ঘ্য ১৬৮ ফুট ও প্রস্থ ৭৬ ফুট। রামকেলির দক্ষিণে আধা কিলোমিটার দূরত্বে বারোদুয়ারি মসজিদটি অবস্থিত। ইট ও পাথরের বিশালাকার আয়তাকার কাঠামোযুক্ত এই মসজিদটি গৌড়ের বৃহত্তম স্মৃতিসৌধ। নামের অর্থ দ্বাদশ দরজা হলেও এই স্মৃতিস্তম্ভটির আসলে এগারোটি দরজা রয়েছে। এই বিশাল মসজিদটির নির্মাণকাজটি আল্লাউদ্দিন হুসেন শাহ দ্বারা শুরু করা হয়েছিল এবং তার পুত্র নাসিরুদ্দিন নুসরত শাহ ১৫২৬ সালে এটি সম্পন্ন করেছিলেন। ইন্দো-আরবি স্টাইলের স্থাপত্যশৈলীর এবং শোভাময় পাথরের খোদাই বারো দুয়ারি পর্যটকদের জন্য একটি বিশেষ আকর্ষণ। 


দাখিল দরওয়াজা


দাখিল দরওয়াজা, ১৪২৫ সালে নির্মিত একটি চিত্তাকর্ষক প্রবেশদ্বার, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম স্মৃতিস্তম্ভ। ছোট লাল ইট এবং পোড়ামাটির কাজ দিয়ে তৈরি, এই প্রভাবশালী কাঠামোটি ২১ মিটারেরও বেশি লম্বা এবং ৩৪.৫ মিটার প্রশস্ত। এর চার কোণে পাঁচতলা উঁচু টাওয়ার শীর্ষে রয়েছে। কোনও দুর্গের প্রধান প্রবেশদ্বারটি পরে এটি চারপাশের বাঁধগুলির মধ্য দিয়ে খোলে। দুর্গের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে, একটি ২০ মিটার উঁচু প্রাচীর একটি পুরানো প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ ঘিরে রেখেছে। আগে এখান থেকে কামান নিক্ষেপ করা হত। তাই গেটটি সালামি দরওয়াজা নামেও পরিচিতি লাভ করে।



ফিরোজ মিনার 


দাখিল দরজা থেকে এক কিলোমিটার দূরে ফিরোজ মিনার। এটি সুলতান সাইফুদ্দিন ফিরোজ শাহ ১৪৮৫-৮৯-এর সময় নির্মাণ করেছিলেন। কুতুব মিনার সদৃশ এই পাঁচতলা টাওয়ারটি ২৬ মিটার উঁচু এবং পরিধি ১৯ মিটার। টাওয়ারের প্রথম তিনটি তলাটির বারোটি সংলগ্ন মুখ রয়েছে এবং উপরের দুটি তলা গোলাকার আকারের। এই ল্যান্ডমার্কটি পীর-আশা-মিনার বা চিরাগদানি নামেও পরিচিত। মসজিদটিতে হিন্দু মন্দিরের স্থাপত্যের চিহ্নও রয়েছে।


গুমতি দরওয়াজা


চিকা মসজিদের উত্তর-পূর্বে দাঁড়িয়ে থাকা গুমতি দরজাটি ১৫১২ সালে আল্লাউদ্দিন হুসেন শাহ নির্মাণ করেছিলেন। ইট এবং পোড়ামাটির তৈরি, এই শিল্পকর্মে বোনা একসময় উজ্জ্বল রঙগুলি এখনও আংশিকভাবে দৃশ্যমান। কথিত আছে যে সজ্জাতে আসল স্বর্ণ ব্যবহৃত হত। দরজা যদিও এখন জনসাধারণের জন্য বন্ধ রয়েছে।


আদিনা মসজিদ


আদিনা মসজিদ সুলতান সিকন্দর শাহ ১৩৬৯ সালে তৈরি করেছিলেন। ভারতের বৃহত্তম মসজিদের মধ্যে অন্যতম। এটিকে অন্যতম উন্নত মসজিদ বলা হয়ে থাকে। গোঁড়ার নকশা দামাস্কাসের মহান অষ্টম শতাব্দীর মসজিদের ওপর ভিত্তি করে বানানো হয়, বলে জানা যায়। 


রামকেলি


মালদা থেকে প্রায় ১৪ কিলমিটার দক্ষিণে অবস্থিত গৌড়ের পথে একটি ছোট্ট গ্রাম। এই গ্রাম শ্রীচৈতন্যদেবের অস্থায়ী বাড়ি হিসেবে বিখ্যাত। সেই সময়কার ইতিহাস বলে, তিনি বৃন্দাবনে যাওয়ার পথে কিছুদিন এখানে থেকেছিলেন। দুটি তমাল এবং কদম্ব গাছের একটি চৈতন্যদেবের পায়ের চিহ্ন এখনও রয়েছে, এমনটাই বলে থাকেন স্থানীয়রা। 


লুকোচুরি ফটক 


লাখছিপি দরওয়াজা বা লুকোচুরি গেটটি কদম রসুল মসজিদের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। কথিত আছে যে, শাহ সুজা এটি ১৬৫৫ সালে মুঘল স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি করেছিলেন। ইতিহাসবিদদের তরফে বলা হয়ে থাকে, এটি ১৫২২ সালে আল্লাউদ্দিন হুসেন শাহ নির্মাণ করেছিলেন। রাজপ্রাসাদের পূর্ব পাশে অবস্থিত, এই দ্বৈত দ্বারবাজা প্রাসাদের প্রধান প্রবেশদ্বার হিসাবে রাখা হয়। উদ্ভাবনী স্থাপত্য শৈলী হিসেবে এই জায়গা আকর্ষণীয়।


মালদার ইতিহাস


১২০৪ সালে গৌড় আক্রমণ করেন খিলজি বংশের তৎকালীন অধিপতি বখতিয়ার খিলজি। এরপর মালদায় রাজ করেন ইলিয়াস শাহ, ফারুখ শাহ, সিকন্দর শাহ, আলউদ্দিন হুসেন শাহ, নাসিরুদ্দিন নসরত শাহের মতো মুসলিম রাজারা। শের শাহ সুরির আফগান, ফিরোজ শাহ তুঘলক, গিয়াসউদ্দিন তুঘলক এবং মোঘল সাম্রাজ্যের পদাঙ্কের নিশানও রয়েছে এই মালদাতেই। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজদৌলাকে যুদ্ধে হারিয়ে ইংল্যান্ডের ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশির দখল নিলে, তার প্রভাব মালদাতেও পড়ে। ১৭৭১ সালে মালদাতে ইংরেজদের আধিপত্য কায়েম হয়। নাম দেওয়া হয় ইংরেজ বাজার। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতাকালীন দেশভাগের প্রভাব এই জেলায় ভীষণভাবে পড়ে। র‌্যাডক্লিফের তৈরি ম্যাপে মালদার একটা অংশ থেকে যায় পশ্চিমবঙ্গে। অন্য অংশ চলে যায় পূর্ববঙ্গে। একদা সাঁওতাল বিদ্রোহেরও পীঠস্থান হয়ে ওঠা মালদা দুই বাংলারই গর্ব।