কলকাতা : 'নাট্যজগতে গভীর শূন্যতা।' চলে গেলেন কিংবদন্তি নাট্য ব্যক্তিত্ব মনোজ মিত্র। ৮৬ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ। বার্ধক্যজনক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। এদিন সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে সল্টলেকের ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বর্ষীয়ান নাট্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রয়াণে গভীর শোকের ছায়া নাট্যজগতে। একের পর এক শিল্পী তুলে ধরলেন নাট্যজগতে মনোজ মিত্রের অসাধারণ অবদানের কথা।


তাঁর প্রয়াণে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তী। তিনি বলেন, "মনোজ মিত্র একজন শুধু অভিনেতা-নাট্যকার নন।অভিনেতা-নাট্যকার-পরিচালক-চলচিত্র অভিনেতা। ওঁর গদ্য লেখা অসাধারণ ভাল। মনোজ আমাদের থিয়েটারে একজন...উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্র, অজিতেশ বন্দ্য়্যোপাধ্যায়ের পর...যাঁরা দাপটের সঙ্গে কাজ করেছেন...ওই একই রকম...। উৎপল দত্ত নাটক লিখতেন, অভিনয় করতেন, পরিচালনা করতেন। মনোজ সেই গোত্রের মানুষ। নাটকের সবক্ষেত্রেই ছিল তাঁর অসাধারণ দখল। পদে পদে নাটক করে গেছেন। বহু চরিত্র অসাধারণ... যেগুলো এখনও আমাদের চোখে জ্বলজ্বল করে। নাটকের মধ্যে যেভাবে তিনি রসবোধ সঞ্চার করতেন, সেটা ছিল অসাধারণ। উপভোগ্য সবার কাছে। একটা বন্ধু হারানোর দুঃখ তো পেয়েছি। সেইসঙ্গে বলব, থিয়েটার একজন বড়মাপের সৃজনশীল শিল্পীকে হারাল।"


নাট্যব্যক্তিত্ব দেবেশ চট্টোপাধ্যায় : দীর্ঘ সময়ে ওঁকে বিভিন্ন রকমভাবে দেখেছি। যখন নাট্য অ্যাকাডেমির প্রধান হিসাবে কাজ করেছেন, অনেক রকম ভাবনা তাঁর মাথায় থাকত। সবসময় কাজে এগিয়ে দিয়েছেন। অসম্ভব খোলা মনের মানুষ ছিলেন। বাংলার মৌলিক নাটকের ক্ষেত্রে তো ওঁর অবদান অনস্বীকার্য। ওঁর দেশের বাড়ি বাংলাদেশের সাতক্ষীরায়, আমারও তাই। এরকম অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে। শেষ, দুই বছর আগে কল্যাণীতে দেখা হয়েছিল। দেখা হলেই আগে জড়িয়ে ধরতেন। শরীরে সেটা লেগে থাকুক আজীবন। আমাদের নাট্যজীবনে বটবৃক্ষের মতো ছিলেন।  


নাট্যব্যক্তিত্ব দেবশঙ্কর হালদার : মনোজদা-র এরকম প্রস্থান শব্দ ও ভাষায় গুছিয়ে বলা শক্ত। মনোজদা এমন একজন মানুষ, যিনি আমাদের মুখে ভাষা জুগিয়েছেন। থিয়েটারের ভাষা জুগিয়েছেন। ভাষাটা এই কারণে নয় যে শুধুমাত্র নাটক লিখেছেন, নাটক উনি যে ভঙ্গিমায় লিখেছেন এবং সেই নাটকগুলো যেভাবে মঞ্চস্থ হতে দেখেছি, কখনো কখনো তার মধ্যে অভিনয় করেছি। আমার মনে হয়েছে এরকম সহজ, সাবলীল...একই সময়ে সমসাময়িক বিষয়কে ধরা এবং সেটা এত সহজভাবে ধরা। অথচ তার মধ্যে সবরকম দর্শন ক্রিয়া করছে, এটা একটা মারাত্মক ব্যাপার। আমাদের সময়ে, যখন আমরা বড় হচ্ছি...উনি এমন একজন নাট্যকর এবং একজন নাট্যশিল্পী যিনি সবদিক থেকেই শিক্ষা দিতে পেরেছিলেন। আমি সেই অর্থে সরাসরি ওঁর ছাত্র ছিলাম না, কিন্তু  ওঁর কাজ দেখে এবং উনি যখন আমাদের কাজ দেখে যে বিশ্লেষণ করেছেন, সেই বিশ্লেষণ দেখেও বুঝতে পেরেছি উনি কত বড় মাপের একজন নাটকের শিল্পী। অদ্ভুত ভাবুক ছিলেন। আমি তখন ওঁকে তাকিয়ে দেখেছি কী অসম্ভব সুন্দর লাগত। আসলে যা বলছেন না সেটাও একটা ভাষা হয়ে প্রকাশ পাচ্ছে ওঁর শরীরের মধ্যে। উনি আমাকে ভালবাসতেন। আমি ওঁকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতাম। একজন নাটকে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। একটা অপূরণীয় ক্ষতি। এ পূরণ হবে না। উনি সহজেই সকলকে ধরতে পারেন। আকর্ষণ করতে পারেন। আজও পৃথিবীর কোনায় কোনায় যেখানে বাংলা নাটক করবেন ভাবছেন বাঙালিরা, তখন প্রথম যে নাটকটি হাতে তুলে নিচ্ছেন সেটি মনোজ মিত্রের নাটক।


নাট্যব্যক্তিত্ব মেঘনাদ ভট্টাচার্য বলেন : রবীন্দ্রনাথের পরে আমাদের যে তিনজন নাট্যকার বাংলা থিয়েটারকে অসম্ভব পুষ্ট করে গেছেন, তার মধ্যে- বাদল সরকার, মোহিত চট্টোপাধ্যায় এবং মনোজ মিত্র। আগের দু'জন আগেই প্রয়াত হয়েছেন। আজ চলে গেলেন আমাদের শেষ অবলম্বন মনোজ মিত্র। সারা পৃথিবীতে যেখানেই বাঙালি আছেন, সেখানেই মনোজ মিত্র আছেন। কারণ, মনোজ মিত্রের নাটক সেখানে রয়েছে। শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গে নয়, ভারত এবং পৃথিবীর সর্বত্র। তাঁর দেখার চোখ ছিল একদম আলাদা। তাঁর মতো মহান মানুষকে হারিয়ে আমরা নিঃস্ব বোধ করছি।