কলকাতা: 'সন্তান যখন জন্ম নেয়, সেই যন্ত্রণা, সেই উৎকন্ঠা, সেই ধকল, মা ছাড়া, কেই বা ভোগ করে? সব মা, একাই মা হয়। সে অর্থে দেখতে গেলে সব মা-ই সিঙ্গল মাদার'


মাতৃদিবস উপলক্ষ্যে কথা হচ্ছিল পূর্ব ভারতের প্রথম আইভিএফ সিঙ্গল মাদারের সঙ্গে। যিনি সন্তানের বাবার পরিচয় না দিয়ে আইভিএফ পদ্ধতিতে মা হয়েছিলেন এক দশক আগে। স্রোতের অনেকটা বিপরীতে সাঁতার কেটে। ইলিনা বণিক। খ্যাতনামা শিল্পী। তাঁর চোখে সব মা-ই সিঙ্গল মাদার। কারণ মাতৃত্বের চ্যালেঞ্জ আর কেউ ভাগ করে নেয় না। 




বাবার পরিচয় উল্লেখ করেননি কোথাও কোনওদিন। কিন্তু বলতে দ্বিধা করেন না, বিয়ের সম্পর্কে থেকে মা হতে চাননি। চেয়েছিলেন মানসিক রসায়ন যেখনে জোরালো, সেই মানুষটির অংশ থেকে মাতৃত্ব উপভোদ করতে। করেওছেন। তাঁর কথায়  'সে সময় কলকাতার বহু চিকিৎসক আমায় বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। বলা যায়, নীতি পুলিশি করেছেন। তাই অনেকটা সময় লেগে গিয়েছিল। নইলে হয়ত আরও এক সন্তানের মা হতে পারতাম ' 


জন্মের আগে শুধু নয়, সন্তানকে বড় করতে গিয়ে একাধিক সমস্যায় পড়তে হয়েছে ইলিনাকে। তবু তিনি হার মানেননি। মেয়ে অমরাবতীকে স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে সিকিউরিটি গার্ডের কটু কথা থেকে, আইনি প্যাঁচ-পয়জার, কী না ভোগ করতে হয়েছে তাঁকে। সিঙ্গল মাদার বলে ঘর ভাড়াও পাননি এ-শহরে। কিন্তু হাল ছাড়েননি ইলিনা। যেমন লড়াই থামাননি এ শহরের খ্যাতনামা চিকিৎসহ ইন্দ্রাণী লোধ। 


মা হওয়ার পর থেকেই পরিবেশটা অনুকূল ছিল না তাঁর কাছে। তবে তাঁর মায়ের একটা কথা কানে বাজত, রোজ রোজ কাঁদার থেকে একদিন কেঁদে সব চুকিয়ে দেওয়া শ্রেয়। শক্ত মনে করেছিলেন তেমনটাই। বিবাহবিচ্ছেদের পর প্রায় ৯ বছর ধরে লড়েছেন আই লড়াই ছেলের কাস্টডির জন্য। সুপ্রিম কোর্টে শিড়দাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়েছেন অধুনা ডাক্তার, সন্তান রাজর্ষির জন্য। শহরের অন্যতম ব্যস্ত চিকিৎসককে চেম্বার, রাউন্ড ছেড়ে কোর্টে ছুটতে হয়েছে, প্রমাণ করতে তিনি সন্তানের দায়িত্ব নিতে কতটা আগ্রহী।




'সারাদিন দম ফেলতে পারছি না তখন এত পেশেন্ট। অথচ কোর্টের তারিখ মিস করতেও পারছি না। তাতে তো বিপক্ষ বলার সুযোগ পেয়ে যাবে মা আগ্রহী নন। সব ফেলে ছুটেছি। ' বলতে বলতেই ইমোশনাল ইন্দ্রাণী। ছেলের শরীর খারাপ তাই চেম্বার বন্ধ রাখতে হয়েছে, স্কুল বাস আসেনি ...সব কাজ পণ্ড করে গাড়ি চালিয়ে ছেলেকে স্কুলে দিতে গেছি ... গাড়ি চালিয়েছি কাঁদতে কাঁদতে। খুব কষ্ট লাগত পেরেন্ট-টিচার মিটগুলো যখন একা যেতাম, আর কুট্টু দেখত সবার বাবা-মা একসঙ্গে এসেছেন' 


সন্তানের জন্ম দেননি ঠিকই, কিন্তু এ যাবৎকাল সন্তানতুল্য শ্রীলেখার প্রতিটা ওঠাপড়ার সঙ্গী শ্রীময়ী কুণ্ডু। দিল্লিবাসী শ্রীময়ীর পরিবারে শ্রীলেখা ওরফে গেরুর আগমন একটু অন্যভাবে। তাঁদের পরিচারিকাকে ফুটফুটে কন্যাসহ ফেলে পালিয়ে যান তাঁর স্বামী। সেই ৩ মাস বয়স থেকে গেরু শ্রীময়ীর পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এরপর আইনি পথে গেরুকে পালনের দায়িত্ব নেয় শ্রীময়ীর পরিবার। ' ডাক্তার তো বলেই দিয়েছিলেন মা হওয়ার সম্ভাবনা আমার খুব কম। কিন্তু শ্রীলেখার দায়িত্ব নিয়ে বুঝলাম, একজনের সঙ্গে লাইফ শেয়ার করা কাকে বলে। ও এখন আমার মেয়ে, বন্ধু, কমরেড, লাভার। '




কখনও তাঁকে শুনতে হয়েছে ,  'শ্রীলেখা কাজের লোকের মেয়ে ! বোঝাই যায় না তো। '  কেউ আবার ভয় দেখিয়েছে ভবিষ্যৎ নিয়ে। কিন্তু এসব কিছুই তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। 'এ বাবা, কাজের লোকের মেয়ে'...দিল্লির স্কুলে ক্রমাগত টিটকিরি শোনা বাচ্চা মেয়েটাকে কোলের কাছে নিয়ে সাহজ জোগাতে জোগাতে, তাঁকেও লোহার মতো শক্ত করে তুলেছেন তিনি। প্রকৃত অর্থেই এখন শ্রীলেখা শ্রীময়ীর আত্মজা। 


এক সময় যে টলটল পা-দুটো আঙুল ধরে চলা শুরু করে, এক সময় জমির উপর শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। আবার আরও সময় গড়ালে সেই হাতই হয়ে ওঠে ভরসার। তবে লেখায়, যে সময়কাল সহজে ধরা যায়, আসলে তা অনেক লম্বা। সে পথে কখনও কাঁকড়, কখনও পাথর, কখনও বালি, কখনও কাঁটা। কিন্তু সন্তানকে তা বুঝতে না দেওয়াই হয় মায়ের একমাত্র লক্ষ্য।  মা ভাবে, বিপুল তরঙ্গও দক্ষ নুলিয়ার মতোই পার করাবে সে। এটাই মাতৃত্বের চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জটা যাঁরা একাই নিচ্ছেন প্রতিদিন তাঁদের লড়াইটা নিঃসন্দেহে আলাদা। মা মানেই গর্ভধারিনী নন। মা মানেই বাবার সহধর্মিনী নয়। মা মানে শুধু পরিবারের কর্ত্রী নয়। মা মানে লাইফকোচ ! প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে চলেছেন শ্রীয়মী, ইলিনা,  ইন্দ্রাণীর মতো মানুষরা।