কলকাতা: তখন সদ্য কাজ গিয়েছে 'সৌভিয়েত দেশ' পত্রিকায় নবারুণ ভট্টাচার্যের (Nabarun Bhattacharya)। অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করা হয়েছিল তাঁকে। হাতে মাইক্রোফোন, কাঁধে ঝোলানো ব্যাটারি-সহ আউটপুট। তিনি বলে চলেছেন। ওদিকে একানব্বইয়ের ব্যস্ত কলকাতায় ছুটে চলেছে গাড়ি,বাস। তারই মধ্যে তিনি বক্তব্য রাখছেন, সোভিয়েত কনস্যুলেটের (Soviet Consulate) বিরুদ্ধে। যদিও একুশ বছরের চাকরি জীবন সাঙ্গ হলেও, পড়ল না দাঁড়ি। সোভিয়েতের পাশাপাশি নবারুণের প্রশ্নের কাঠগড়ায় উঠে এল পশ্চিমবঙ্গ তথা দেশের একাধিক রাজ্যের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি। তিরানব্বইয়ে, দিগন্তের দরজায় কড়া নাড়লেন 'হারবার্ট'। সমুদ্রে নেমে বললেন..
স্থলবায়ু বহে বেগে
জলবায়ু ভালো নয়
অক্টোপাসের ভয়
কি হয়, কি হয়
'নবারুণ'
আটচল্লিশ সাল। বিজন ভট্টাচার্য এবং মহাশ্বেতা দেবীর কোলে আলো ছড়িয়ে এলেন 'নবারুণ।' বরাবর আকণ্ঠ রাজনৈতিক লেখা লিখেও, জীবনকালে বাম-ডান কোনও শাসকেরই প্রাধান্য পেতে চাননি তিনি। তাঁর একের পর এক লেখা নিয়ে নাটক, সিনেমা তৈরি হয়েছে। নাটক করেছেন কলকাতার মঞ্চে। অর্থনৈতিক অবস্থা একটা সময় দারুণ স্বস্তির ছিল না বলেই কি শহরটাকে অন্য চোখে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি ?
এই মৃত্য়ু উপত্য়কা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাস মঞ্চ আমার দেশ না
এই বিস্তীর্ণ শশ্মান আমার দেশ না।
উজ্জ্বলতম তাঁরা
নবারুণের আকাশে আরও এক উজ্জ্বলতম তাঁরা 'লুব্ধক।' লেখক নিজেই নিজের এই লেখায় একটা প্রশ্ন-উত্তর পর্বের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন। একটা অংশে লিখেছেন, ..এই অসংলগ্ন কথাবাত্রা থেকে কোনও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব হবে না। উপন্যাসের শেষ অংশে, যেখানে কোনও অন্তর্ঘাত ছাড়াই, শহর ধ্বংসের পথে, শহরকে প্রত্যাখ্যান করছে কুকুরের দল। যেখানে লেখকের বর্ণনা অনেকটা এমন, ছায়াপথ ধরে, সুমদ্রের উপরে উড়ে যাচ্ছে সারমেয়-র দল।
'দেশ'টা কোথায় ?
'আমি পলিটিক্যালি পুরো ব্যাপারটাকে দেখি।..এবং আমার মনে হয় না, কোনও শর্তে এই সমাজকে, আমি গ্রহণ করতে পারি।' নবারুণের গল্পে-কবিতায়, চরিত্র নিয়ে তাঁর মন্তব্য 'এরাই আমাকে ফ্যাসিনেট করে। এদের মধ্য দিয়েই আমি সব কিছু পাই। এরাই আমার সব কিছু।' আর এভাবেই জন্ম নিয়েছে 'অটো' কিংবা 'কাঙাল মালসাট'। যদিও এই সমাজ তাঁর কবিতা-গল্পের আয়নায় কতটুকু ফিরে দেখেছিল নিজেকে, সে প্রশ্ন আজ ব্রাত্য। কারণ তিনি বলেছেন..
যারা দেখতে পায় না
তারাও অনেকসময় আমাকে পড়তে পারে।
'আড়বালিয়া আর নবারুণ'
আজীবনকাল যার লেখনীতে উঠে এসেছে রাজনৈতিক অস্থির চিত্র, জীবন সায়াহ্নে তিনিও ফিরেছেন, তাঁর জন্মদাতার দেশে। অমন নিবীঢ় শান্তি আর কি কোথাও আছে ? যেখানে স্কুলে, খেলার মাঠের ঘাসে, পুকুরের চাতালে,তেঁতুল গাছে- বাবা এবং দাদুর পরশ লেগে আছে। শেষ জীবনে, সেই রাস্তায় তিনি ফিরেছেন বারবার, বলেছেন, 'মনে হচ্ছে আমি আমার বাবার সঙ্গে হাঁটছি।' তবে কি সুদূর ১৯৪৮ পেরিয়ে, যৌবন পেরিয়ে, জন্মদিনটা কি আজ ? দেশটার নাম কি 'আড়বালিয়া' ?
আপন স্বেদগন্ধে ব্যস্ত থাকো সুদূরপিয়াসী,দ্যাখো জলের অভ্যান্তরে অস্ত্র থেমে আছে, প্রত্যেক
পদক্ষেপে ফিরতি যাচ্ছে কোষের বিন্যাস, থমকে আছে সমগ্র সকাল তব করতলভঙ্গি শুষে নেবে ব'লে।
ঋণ: নবারুণ ভট্টাচার্য ( হারবার্ট , এই মৃত্য়ু উপত্য়কা আমার দেশ না, মুখে মেঘের রুমাল বাঁধা), চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (গাইড), ডকুমেন্টারি, কৌশিক মুখোপাধ্যায়, শুভাশিস ভট্টাচার্য (আড়বালিয়া আর নবারুণ)।