সমীরণ পাল, হাবড়া : টুকটুকি দাস। রবীন্দ্রভারতী মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দূরশিক্ষায় ইংলিশে এমএ । তাও আবার ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে পাশ ! কিন্তু চাকরির বহু চেষ্টা করেও শিকে ছেড়েনি। অবশেষে মাথায় এসে পড়ল এক আইডিয়া। আর সেই ভাবনারই বাস্ত রূপ -হাবড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে  এমএ ইংলিশ চায়েওয়ালি’ !


চাকরির পরীক্ষা দিতে থাকা আর উত্তর না আসা। কিছুটা হাঁপিয়ে উঠেছিলেন টুকটুকি। বুঝতে পারছিলেন, এ রকম বেশি দিন চলতে থাকলে হতাশা বাসা বাঁধবে।   বাবা প্রশান্ত বাড়িতেই মুদির দোকান চালান। সংসার টানতে মাঝে মধ্যে ভ্যানরিকশাও চালাতে হয়। তখন দোকানে বসেন টুকটুকির মা। দাদা থাকেন মধ্যমগ্রামে। পারিবারিক পুঁজি নেই যে বড় ব্যবসা দাঁড় করাবেন টুকটুকি।


ইউটিউব ঘাঁটতে ঘাঁটতে তিনি এক দিন খোঁজ পান মুম্বইয়ের এক চায়ের দোকানের। সেটিও তৈরি করেছেন উচ্চশিক্ষিত এক যুবক। দোকানের নাম দিয়েছেন নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতাকে জুড়ে দিয়ে। সেই নামই ক্রমশ ‘ব্র্যান্ড’ হয়ে উঠছে ইদানীং। পথটা মনে ধরে টুকটুকির। কিন্তু ভাবনাটায় সায় দিতে পারছিলেন না বাবা-মা।'  হাবড়া শ্রীচৈতন্য কলেজ থেকে ইংলিশ নিয়ে পাস করে, এমএ উত্তীর্ণ মেয়ে খুলবে কি না চায়ের দোকান! তা-ও হয় ? পাঁচ জন কী বলবে?' 


জেদ ধরে বসেন টুকটুকি।  ইউটিউব থেকে এ ধরনের আরও চায়ের দোকান খুঁজে বাবা-মাকে দেখান তিনি, যা তৈরি হয়েছে শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের উদ্যোগে।


এক সময়ে মত দেন বাবা-মা। সেই মতো মাসে আঠারোশো টাকায় চার ফুট বাই চার ফুটের দোকান ভাড়া নিয়ে ফেলেছেন টুকটুকি। সোমবার থেকে চালু হয়েছে চা বিক্রি। ৫ থেকে ৩৫ টাকা দামের নানা রকম চা মিলছে। একা হাতেই সব সামলাচ্ছেন টুকটুকি। দোকানের শুভ মহরতে অনেককে বিনা পয়সায় চা খাইয়েছেন বলে জানালেন।



লোকজন কী বলছেন? একগাল হাসলেন মেয়ে। বললেন, ‘‘প্রথম দিন অনেকে খুব উৎসাহ দিয়ে গেলেন।’’ কিন্তু শুরুর লড়াইটা ছিল ঘরে-বাইরে। চায়ের দোকান দেবে একটা মেয়ে, এ কথা শুনে অনেকে দোকান ভাড়াই দিতে চাইছিলেন না। অনেকে বলেছেন, ‘এ সব তোমার দ্বারা হবে না।’ সে কথা শুনে চোয়াল আরও শক্তই হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘আমি মনে করি, কোনও কাজই ছোট নয়। ইচ্ছে আছে, চায়ের দোকানটাকে দাঁড় করিয়ে নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি করব। নিজের পরিচিতি গড়ে তুলব।’’


কিন্তু দোকানের নাম এমন ধারা কেন? শিক্ষিত হয়েও চাকরি না পাওয়ার যন্ত্রণা? শিক্ষাব্যবস্থাকে কটাক্ষ?


‘‘না না, ও সব কিছু নয়’’— বলছেন টুকটুকি। তাঁর কথায়, ‘‘দোকানের নামে নতুনত্ব রাখতে চেয়েছি। শিক্ষিত হয়েও যে কোনও কাজে এগিয়ে আসা যায়, সেই বার্তাও হয়তো আছে এই নামে।’’


কিন্তু এমএ পাস মেয়ের চায়ের দোকানের এ হেন নাম কি রাজ্যের শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে? সে কথা মনে করছেন না অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার। তাঁর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া, ‘‘ওঁকে অভিনন্দন জানাব। হেরে যাননি। বরং শ্রমের সম্মান বজায় রেখে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। সম্মানের সঙ্গে কাজ করছেন। যুদ্ধ করছেন।’’ কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে তাঁর দাবি, সমাজের কিছু নির্দিষ্ট ধারণা থেকেই প্রচলিত চাহিদা হল, সরকারি চাকরি। দেশের সামাজিক কাঠামো অনুযায়ী কে কী ধরনের কাজ করবেন, তা যেন গতে বাঁধা। তাঁর কথায়, ‘‘এটি কর্মসংস্থান নয়, সমাজের সমস্যা। বাঁধা গতে না চললে বলা হয়, কিছুই যেন হল না জীবনে।’’