সৌমিত্র রায়, হাওড়া: কলেজের পাঠ সম্পূর্ণ করতে পারেননি যদিও। কিন্তু চেষ্টায় খামতি ছিল না তাঁর। তাই পাকা রোজগারের রাস্তা বার করতে ফিজিও থেরাপি-কে বেছে নিয়েছিলেন। হাতে কলমে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। শিক্ষানবীশ হিসেবে দু'চার পয়সা হাতেও আসছিল। কিন্তু পাকা রোজগারের রাস্তা তৈরি হওয়ার আগে নিজেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন ২৮ বছরের রিমা সিংহ। শুক্রবার দুপুরে পার্ক সার্কাসে পুলিশকর্মীর এলোপাথাড়ি গুলিতে মৃত্যু হল তাঁর (Park Circus Shooting)। 


পার্কসার্কাসে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু রিমার


হাওড়ার দাশনগরের ফকির মিস্ত্রি লেনের বাসিন্দা রিমা। মা, বাবা, ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ভাড়াবাড়িতে বাস। বাবা কারখানার কর্মী ছিলেন। পাঁচ বছর আগেই সেই কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। তার পর থেকে কার্যত বসে গিয়েছেন। মাঝেমধ্যে টুকটাক কাজ করেন বটে। কিন্তু নিয়মিত নয়। অসুস্থ শরীর একেবারেই সায় দেয় না। তাই দু'চার পয়সা হাতে পেলেও, সংসারের একমাত্র রোজগেরে সদস্য ছিলেন রিমাই। কলকাতার রাস্তায় সেই মেয়ের বেঘোরে মৃত্যুর খবর পেয়ে শোকস্তব্ধ পরিবার (Kolkata News)। 


শুক্রবার দুপুরে পার্কসার্কাস দিয়ে যাচ্ছিলেন রিমা।  সেই সময় এসএআর রাইফেল উঁচিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে ছুড়তে রাস্তায় নেমে বেরিয়ে আসেন পুলিশ কনস্টেবল চোডুপ লেপচা। তাতেই গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন রিমা। প্রথমে জানা যায়, অ্যাপ রাইডে চেপে যাচ্ছিলেন রিমা। পরে পুলিশ জানায়, রাস্তায় দিয়ে হেঁটেই যাচ্ছিলেন তিনি। তখনই গুলিবিদ্ধ হন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই গোটা ঘটনা ঘটে যায়। নিজেও আত্মঘাতী হন কনস্টেবল লেপচা। 


আরও পড়ুন: Shootout in Kolkata: ভরদুপুরে কলকাতায় এলোপাথাড়ি গুলি পুলিশকর্মীর, মৃত দুই


দিনে দুপুরে এই ঘটনায় যখন উত্তাল শহর কলকাতা, রিমার বাড়িতে তখনও খবর পৌঁছয়নি (Howrah News)। টেলিভিশনের পর্দায় রিমার নাম দেখে বাড়িওয়ালার পুত্রবধূ ছুটে আসেন বলে জানিয়েছেন রিমার মা। তিনি জানিয়েছেন, এ দিন দুপুর ১২টা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন রিমা। কখন ফিরবেন জানতে চাইলে মাকে জানান, রাত হবে। কিন্তু মেয়ের ফেরার অপেক্ষায় যখন বাড়িতে অপেক্ষায় রয়েছেন মা, রিমার রক্তাক্ত দেহ তখন পড়ে রয়েছে কলকাতার রাস্তায়। 


এবিপি আনন্দর মুখোমুখি হয়ে রিমার মা বলেন, "কিছু বলার ক্ষমতা নেই আমার। মেয়েটা চলে যাবে, ভাবতেও পারিনি। ১২টার সময় হেসে হেসে বেরোল। কখন আসবি জিজ্ঞাসা করলাম, বলল, রাত হবে।"


রিমার মা জানিয়েছেন, কলাবিভাগে দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত এনডি কলেজে পড়েছেন রিমা। তার পর আশানুরূপ ফল না হওয়ায়, আর পড়াশোনা নিয়ে এগোননি। এর পর কাজের দিকে ঝোঁকেন। ফুলেশ্বর থেকে সম্প্রতি ফিজিও থেরাপির প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। কেমন কাজ শিখেছেন, না শিখেছেন, তা দেখতে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কাজেও যেতেন এদিক ওদিক। সেই বাবদ কিছু টাকা কমিশনও মিলত। সংসারের খরচ চলত তাই দিয়ে। এ দিনও সেই কাজেই বেরিয়েছিলেন রিমা। 


সংসারের একমাত্র রোজগেরে সদস্য ছিলেন রিমা


রিমার মা আরও জানিয়েছেন, তাঁর ছোট ছেলে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তার পর তিনিও কাজের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু রিমাই করতে দেননি। ভাইকে আরও পড়াতে চেয়েছিলেন। তার তোড়জোড়ও শুরু হয়েছিল। শীঘ্রই রিমার প্রশিক্ষণ সম্পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সব ভাবনাই অধরাই রয়ে গেল মেয়ের মৃত্যুতে। মেয়ের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর ভেঙে পড়েছেন রিমার মা। বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। ছোট ভাই এক কোণে বসে রয়েছেন বাড়িতে। দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয়রাও ছুটে এসেছেন। কিন্তু কিছুতেই ভরসা পাচ্ছে না রিমার পরিবার। বাড়িভাড়া বাবদ অনেক টাকা বকেয়া রয়েছে, তার উপর এই ঘটনা। সবকিছু কী ভাবে সামাল দেবেন, ভেবে কিনারা করতে পারছেন না। 


তিরিশ ছুঁইছুই রিমার বিয়েও প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পাত্রের বাবা মারা যাওয়ায়, মাঝপথে সব আটকে গিয়েছিল। শুক্রবারই রিমার বাড়িতে এসে দিন ক্ষণ পাকা করতে চেয়েছিলেন পাত্রপক্ষ। বিকেলে আসার কথা ছিল তাঁদের। কিন্তু রিমার মৃত্যুর খবর তাঁদের কানেও পৌঁছেছে বলে জানা গিয়েছে।