অলোক সাঁতরা, চন্দ্রকোনা: উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন ছিল হয়ত। কিন্তু বাড়ির অবস্থা দেখে এগনোর সাহস পাননি। তাই কলেজ থেকে নাম তুলে নিয়ে নিশ্চিত রোজগারের আশায় ভর্তি হয়েছিলেন নার্সিং পড়তে (Nursing)। কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ মাঝপথেই। বাধা সেই টাকা। ভাঙাচোরা মন নিয়ে আর উঠে দাঁড়ানোর সাহস পাননি তিথি দলুই। তাই গলায় বিষ ঢেলে নিজেকে শেষ করে দেওয়াই ঠিক মনে করেছিলেন। কিন্তু শেষ হয়ে যাওয়ার আগেও আরও লড়াই বোধহয় বাকি ছিল। তাই টানা ১৭ দিন আইসিইউ-তে থাকার পর মৃত্যু হল তিথির (Nursing Student Suicide)।
ফি জমা দিতে না পেরে বাড়ি ফিরে আসতে হয় তিথিকে
পশ্চিম মেদিনীপুর (Paschim Medinipur News) জেলার চন্দ্রকোনা (Chandrakona News) পৌরসভার অন্তর্গত ভেরবাজারের গ্রামের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা তিথি। গত ১৪ অগাস্ট রাতে বাড়িতে বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তড়িঘড়ি মেয়েকে বাসপাতালে ভর্তি করেন বাবা জয়দেব দলুই। প্রথমে চন্দ্রকোনা গ্রামীণ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তিথিকে। অবস্থার অবনতি হলে নিয়ে যাওয়া হয় মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে। গত ১৭ দিন ধরে আইসিইউ-তে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিলেন তিনি। শেষমেশ বৃহস্পতিবার মৃত্যু হল তাঁর।
মেয়েটির পরিবার জানিয়েছে, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর কলেজে ভর্তি হন তিথি। কিন্তু বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা দেখে আর পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাহস পাননি। পাড়া-পড়শি, আত্মীয়দের থেকে টাকা ধার করে বেঙ্গালুরুতে নার্সিং কলেজে ভর্তি হয়ে যান। কিন্তু কলেজে ভর্তি হলেওষ দ্বিতীয় কিস্তির টাকা দিতে গিয়ে ফের সমস্যা বাধে। কিছুতেও জোগাড় হয়নি টাকা। ফলে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। মাঝপথে বাড়ি ফিরে আসতে হয়।
এর পরও হাল ছাড়েননি তিথি। রাজ্য সরকারের স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড পেতে চেষ্টা চালাতে শুরু করেন। আশা ছিল, কোনও রকমে ঋণ পেলে সেই টাকায় আবার নতুন করে শুরু করতে পারবেন। কিন্তু প্রশাসনের দরজা থেকে ব্যাঙ্ক, দরজায় দরজায় ঘুরেও তিথি ক্রেডিট কার্ড পাননি বলে অভিযোগ পরিবারের। তাতেই ভেঙে পড়েন তিনি। তার পরই বিষপান করেন বলে জানিয়েছে তাঁর পরিবার।
স্বচ্ছল ভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলেন যে মেয়ে, তাঁর এমন পরিণতিতে শোকস্তব্ধ গোটা পরিবার।মেয়েকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন জয়দেব। বিগত ১৭ দিন হাসপাতালেই ছিলেন তিনি। মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন বলে আশায় বুক বেঁধেছিলেন। এখন মেয়ের নিথর দেহ ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে তাঁকে। জয়দেব জানিয়েছেন, মেয়ের সঙ্গে একাধিক ব্যাঙ্কে ঘুরেছেন তিনিও। কিন্তু ঋণ মেলেনি। তাতে গত একমাস ধরে অবসাদে ভুগছিলেন মেয়ে। কিন্তু এমন ঘটনা ঘটে যাবে, তা কল্পনা করতে পারেননি তিনি। স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডের ঘোষণা করেছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই জয়দেবের আর্জি, আর কোনও বাবা-মা যেন এই কষ্ট না পান।
আরও পড়ুন: অবিলম্বে নিয়োগের দাবিতে ফের চাকরিপ্রার্থীদের বিক্ষোভ, পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে ধুন্ধুমার
তিথির মৃত্যুতে শোকে আচ্ছন্ন তাঁর পরিবার। তা নিয়ে যদিও রাজনৈতিক তরজাও তুঙ্গে। তিথির মৃত্যুর খবর পেয়ে এ দিন হাসপাতালে পৌঁছে যান বিজেপি-র মেদিনীপুর সাংগঠনিক জেলা সভাপতি তাপস মিশ্র। তিনি বলেন, ‘‘ধাপ্পাবাজি, মিথ্যাচার করে সরকার প্রকল্প ঘোষণা করেছে। প্রকল্পগুলি চালাতে পারছে না। টাকা পয়সা বেলাইন হয়ে নেতা-মন্ত্রীদের পকেটে ঢুকে যাচ্ছে।সে ই সরকারের কাছে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা অন্যায়, ভুল। তিথি ভুল করেছিলেন। এই স্বপ্ন দেখা উচিত হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখের কথায় বিশ্বাস করেছিলেন তিথি। এই ধাপ্পাবাজ সরকারকে এ বার শিক্ষা দেওয়া দরকার।’’
তৃণমূলের জেলা কো-অর্ডিনেটার অজিত মাইতি যদিও দোষ চাপিয়েছেন ব্যাঙ্কের ঘাড়ে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ব্যাঙ্ক শিল্পপতিদের ঋণ দিচ্ছে, অথচ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চালু করা স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডে ঋণ দিচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করব এর পর কোনও দিন কেউ যাতে এই হতাশার শিকার না হন।’’ ছাত্ৰছাত্রীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘‘যদি কোনও ব্যাঙ্ক ঋণ দিতে না চায়, সে ক্ষেত্রে মহকুমাশাসক বা জেলাশাসকের সঙ্গে যেন তাঁরা দেখা করেন। ওঁরা অন্তত চেষ্টা করে দেখবেন।’’
টানা ১৭ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে শেষ তিথি
এ নিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার দীনেশ কুমার জানিয়েছেন, দ্বিতীয় বর্ষের ফি জমা দিতে না পেরে বিষপান করেন তিথি। ২০২১ সালে বেঙ্গালুরুর ‘অ্যাস্টার স্কুল অফ নার্সিং’-এ ভর্তি হন তিনি। স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডের জন্য আবেদন করেছিলেন। তার অনুমোদনও পাঠানো হয়েছিল স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া-র চন্দ্রকোনা শাখায়। কিন্তু বেঙ্গালুরুর ওই কলেজ ইন্ডিয়ান নার্সিং কাউন্সিল অনুমোদিত নয় বলে ঋণের আবেদন খারিজ করে দেয় ব্যাঙ্ক। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।