পূর্বস্থলি: ছুটি থাকলেও রাখি পূর্ণিমার দিন স্কুলে যাওয়ার চল ছিল। হিন্দু-মুসলিম-ক্রিস্টান নির্বিশেষে পরস্পরের হাতে রাখি বেধে দিতেন ছাত্রছাত্রীরা। কিন্তু রাজনীতির হাওয়া বদলের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা প্রাঙ্গনের পরিবেশও কি পাল্টে যাচ্ছে একটু একটু করে? পূর্বস্থলির নাদনঘাটের স্কুলে হিন্দু ও মুসলিম পড়ুয়াদের মিড ডে মিল আলাদা রান্না করার ঘটনাই এই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে এমন ঘটনা দিনের পর দিন চলল কী করে, কেন কোনও পদক্ষেপ করা হল না এতদিন, উঠছে প্রশ্ন। (Purbasthali Midday Meal Controversy)

পূর্ব বর্ধমানের নাদন ঘাট থানার অন্তর্গত কিশোরীগঞ্জ মনমোহনপুর অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে এই ঘটনা সামনে এসেছে। ওই সরকারি স্কুলের পাঠ্যবই থেকে এখনও নজরুল বা তাঁর লেখা 'এক বৃন্তে দু'টি কুসুম' যদিও উঠে যায়নি। কিন্তু হিন্দু  ও মুসলিম পড়ুয়াদের মধ্যে বিভাজন ফুটে ওঠে মিড ডে মিল রান্নায়। হিন্দু ও মুসলিম পড়ুয়াদের মিড ডে মিল আলাদা আলাদা রান্না হচ্ছিল সেখানে। (Purba Bardhaman News)

পাক প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ওই স্কুলে মোট পড়ুয়ার সংখ্যা ৭২, হিন্দু ৪৩, মুসলিম ২৯। শিক্ষক ও শিক্ষিকার সংখ্যা চার।  স্কুলটিতে মিড ডে মিল রান্নার ঘর ছিল একটাই। রান্নার জন্য ব্যবহৃত এলপিজি সিলিন্ডারও একটিই। কিন্তু সেই সিলিন্ডারে দু'টি পাইপ জুড়ে, পৃথক ওভেনে রান্নার বন্দোবস্ত করা হয়। শুধু তাই নয়, দুই ধর্মের পড়ুয়াদের জন্য আলাদা আলাদা রাঁধুনির ব্য়বস্থাও করা হয়। সোনালি মজুমদার একটি ওভেনে রান্না করছিলেন হিন্দু পড়ুয়াদের জন্য। অন্য ওভেনে মুসলিম পড়ুয়াদের জন্য রান্না করছিলেন ধানু বিবি। ধর্মের নিরিখে বাসনপত্র, হাঁড়ি, কড়াই, খুন্তিও আলাদা করা হয়েছিল।

অর্থাৎ 'এক বৃন্তে দু'টি কুসুম' ভুলে, 'এক সিলিন্ডারে দু'টি ওভেন, আলাদা খাবে হিন্দু-মুসলমান' নীতি মেনে নিয়েছিলেন সকলেই। বিষয়টি সামনে আসায় শোরগোল পড়ে গেলেও, এতদিন বিনা একটি শব্দও খরচ করেননি কেউ। বরং হিন্দু ও মুসলিম পড়ুয়াদের মিড ডে মিল পৃথক ভাবে রান্না করার রীতি বৈধতা পেয়ে গিয়েছিল। একেবারে শুরু থেকেই নাকি এই রীতি বজায় ছিল স্কুলটিতে। রাঁধুনিরাও আলাদা আলাদা রান্নার কথা মেনে নিয়েছেন। 

এতদিন পর তাহলে টনক নড়ল কী করে? এর নেপথ্যে রয়েছেন প্রধান শিক্ষক তাপস ঘোষ। একবছর আগেই ওই স্কুলে দায়িত্ব নিয়ে আসেন তিনি। তিনি জানিয়েছেন, পৃথক ভাবে রান্না করতে, আলাদা আলাদা রাঁধুনি রাখতে বাড়তি খরচও হচ্ছে। সেই নিয়ে অভিভাবকদের আলোচনায় বসতে অনুরোধ করেছিলেন তিনি। বুধবার সেই মতো বৈঠক হয় অভিভাবকদের নিয়ে। তার পর থেকে সব পড়ুয়ার মিড ডে মিল একত্রে রান্না হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে। পৃথক ভাবে রান্না হোক, তিনিও চান না বলে জানিয়েছেন প্রধান শিক্ষক।

বিষয়টি সামনে আসতেই নিন্দার ঝড় উঠেছে। কালনার মহকুমা শাসক জানিয়েছেন, স্কুলে দুই প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন তিনি। ভবিষ্যতে যেন মিড ডে মিল আলাদা আলাদা রান্না করা না হয়, কডডা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষকে। কেন এমন চলছিল প্রশ্ন করলে, রাঁধুনি ধানু বিবি বলেন, "সিলিন্ডারে পাইপ আছে। একদিকে আমি রান্না করি, অন্য দিকে উনি। থালা-বাটিও সব আলাদা। বলা হয়, হিন্দুরা মুসলিমদের ছোঁয়া খাবে না। যখন থেকে কাজ শুরু হয়েছে, এমনই চলছে। আমাদের খারাপ লাগলেই বা কী। যা বলা হয়, তা-ই করি।" সোনালিও মজুমদারও জানান, হাতা-খুন্তি সব আলাদা। একটাই সিলিন্ডার, পাইপ আলাদা। খাওয়ার সময় হিন্দু ও মুসলিম পড়ুয়ারা খেতেও বসে আলাদা আলাদা।

জানা গিয়েছে, এর আগেও অভিভাবকদের নিয়ে বৈঠক করেছিলেন প্রধান শিক্ষক। বুধবার যে বৈঠক হয়, তাতে পুলিশও উপস্থিত ছিল বলে জানা গিয়েছে। তার পরই আজ থেকে বদলেছে পরিস্থিতি। এতদিন পর পরিস্থিতি বদল নিয়ে প্রধান শিক্ষক তাপসবাবু বলেন, "আমি দু'টো রান্না চাই না। স্কুলের উন্নতি করতে চাই, ভাল খাওয়াতে চাই। কিন্তু এখানে দ্বিগুণ খরচ হচ্ছে।" 

এ প্রসঙ্গে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, "মিড ডে মিলের একটা এসওপি রয়েছে। সেই নির্দেশ লঙ্ঘন করা যায় না। তবে আমি শুনেছি, মুসলিম এলাকায় অভিভাবকরা গিয়ে হালাল ছাড়া মাংস দেওয়া যাবে না। এই বিতর্কে অনেক জায়গায় মাংস বন্ধ হয়েছে। ঠিকই আছে। ওঁরা হালাল ছাড়া খাবেন না, আমরাও ঝটকা ছাড়া খাব না।"

যদিও তৃণমূলের জয়প্রকাশ মজুমদারের বক্তব্য, "শিশুদের মনে বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া, সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢোকানো, ভোটারদের বিষিয়ে দেওয়া, হিন্দু-মিসসমান করে সমাজের বিভাজন কখনও হতো না এখানে। এটা বিজেপি শুরু করেছে। স্কুলগুলিকে চাপ দিয়ে বিজেপি এসব করছে। হিন্দু-মুসলিম আলাদা করছে, ছোঁয়াছুঁয়ি ফেরত আনতে চাইছে, বাংলার বুকে মধ্যযুগীয় অস্পৃশ্যতা ফেরত আনতে চাইছে।"