কমলকৃষ্ণ দে, পূর্ব বর্ধমান: রাজা নেই, রাজত্ব নেই। জায়গায় জায়গায় চুন সুরকির দেওয়াল ভেঙে পড়েছে আবার কোথাও পলেস্তারা খসে পড়েছে। দেওয়াল বেয়ে জল পড়ায় শেওলা হয়ে গেছে আবার কোনো দেওয়াল চলে গেছে বট অশ্বত্থের দখলে। রাজ ঐতিহ্যের শেষ সলতে বলতে ভগ্নদশা মন্দির ।

যেখানে অধিষ্ঠান করেন রাজার কুলদেবতা লক্ষী নারায়ন জিউ। মন্দিরের ভিতরে দেওয়ালে টেরাকোটার কারুকার্য, দেওয়ালের পলেস্তারা চারদিকে খসে পড়ছে। রাজপরিবারের মন্দিরের মূল ফটকও ভেঙে পড়ছে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে।আর এই মন্দিরেই বর্তমানে শারদীয়ায় পুজিত হন পটেশ্বরী। পটের মধ্যেই মা দুর্গার ছবি। তিনি সপরিবারে মর্তে এসেছেন।পুরো পট টাই শোলার সাজে সজ্জিত। প্রত্যেক ১২ বছর অন্তর মায়ের অঙ্গরাগ হয় অর্থাৎ নতুন করে পটে মা দূর্গার ছবি আঁকা হয়। এখানে পটেশ্বরীকে মা চণ্ডী রূপে পুজো করা হয়। নয় দিনে চণ্ডীর নয় রূপে পুজো করা হয়।


প্রায় ৩০০-৩৫০ বছর আগে বর্ধমান মহারাজা মহতাব চাঁদ রাজ বাড়িতে দূর্গা পুজো শুরু করেন। পুজোর জন্য মন্দিরও ছিলো। বর্তমানে মন্দির ভেঙে যাওয়ায় রাজ কুলদেবতার মন্দিরেই পটেশ্বরীর পুজো হয়।
তবে সময়ের বদলানোর সাথে সাথে রাজপরিবারের পটেশ্বরী দুর্গা পুজোর জৌলুস কমেছে। কিন্তু কমেনি রাজ ঐতিহ্য, আচার ও রীতিনীতি।  রাজ আমলে ধুমধাম করে পটেশ্বরী দুর্গাপুজো হত।বহু মানুষের আগমন হত বর্ধমান মহারাজের দূর্গাপুজোয়। দামোদর নদীর ওপার থেকেও অনেক মানুষজন পায়ে হেঁটে, গরুর গাড়িতে করে আসতেন  রাজার পুজো দেখতে। জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে পুজো হত। প্রত্যেকদিনই ভিড় লেগে থাকত মন্দির প্রাঙ্গনে। রাজ পরিবারের প্রথা অনুযায়ী রাজ পরিবারের মহিলারা সবার  সামনে আসতেন  না। রাজবাড়ি থেকে গোপন রাস্তা দিয়ে তাঁরা মন্দিরে প্রবেশ করতেন এবং মন্দিরের দ্বোতলায় দর্শনির মাধ্যমে পুজো ও অনুষ্ঠান দেখতেন। মন্দিরে থাকা মানুষ এই রাজ পরিবারের মহিলাদের দেখতে পেতেন না। এখনও দুর্গাপুজোর সময় ভিড় হয়।বর্তমানে একটি ট্রাষ্টির মাধ্যমে দেখাশুনা করা হয় মন্দিরের। তবে রয়েছে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব।  করোনার প্রকোপে গতবার থেকে পুজোর আয়োজন আরও কমেছে। 


 তবে জৌলুস কমলেও পুজোর আচারে কোনও পরিবর্তন হয়নি।এখনো আগের মতই পুরানো রীতি নীতি মেনেই রাজপরিবারে মা পটেশ্বরী দুর্গাকে চণ্ডীরূপে পুজো করা হয়। মহালয়ার পরের দিন প্রতিপদ থেকে বর্ধমানের মহারাজার মন্দিরে দুর্গাপুজো শুরু হয়। নয় দিন ধরে নবরাত্রি পুজো হয়।  পুজোর সময় রাজপরিবারের এক মাত্র বংশধর ছোটো রাজকুমার প্রণয় চাঁদ মহাতাব ন'দিন সস্ত্রীক বর্ধমানে থাকেন এবং নিজে পুজোয় বসেন। তবে করোনা আবহে গতবছর তিনি আসেননি।


দেবী দুর্গার মূর্তি এখানে শালকাঠের কাঠামোর উপর নির্মিত হয়। কাঠের কাঠামোর উপর নানা রং দিয়ে নিপুন তুলির টান তৈরি দশভুজার সপরিবার। এখানে একমাত্র গণেশ ছাড়া দুর্গা,লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক এবং অসুরের মুখের ছবি এমন ভাবে আঁকা আছে শুধুমাত্র একটি চোখ দেখা যায়।শুধু তাই নয় মা দুর্গা বাহন সিংহের জায়গায় আঁকা আছে ঘোড়ার ছবি। আগে এখানে বলি প্রথা ছিলো। তবে বৈষ্ণব মতে পুজো হওয়ায় মেষ-মহিষ বা ছাগ বলি হয়না। রাজাদের আমলে সুপারি বলি হত।এখন অবশ্য কোনও বলি হয় না। নবমীর দিন মা পটেশ্বরীর সামনে নবকুমারী পুজো হয়।অষ্টমীর দিনে মোহনভোগ হিসাবে হালুয়া নিবেদন করা হয়।এছাড়াও থাকে লুচি,ছোলা প্রভৃতি। ৫১ রকমের ভোগ দেওয়া হত আগে।

এখন এই পুজোয় নবমীর রাতে ডাণ্ডিয়া নাচ হয়। নবমীর  রাতে গুজরাতি সম্প্রদায়ের মানুষ নাটমন্দিরে ডাণ্ডিয়া নাচ করেন।