কমলকৃষ্ণ দে, পূর্ব বর্ধমান: কথায় বলে ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। আবার অনেকের মতে নামকরণের ভাল প্রভাবও পড়ে মানুষের উপর। একেবারেই এই দুইয়ের সঙ্গমস্থলেই সকলের বিশ্বাসকে জিতিয়ে দিয়েছেন তিনি। জীবনের যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা, বস্তাপচা ট্য়াবুকে পিছনে ফেলে মাধ্যমিক (Madhyamik 2023) দিচ্ছেন এবার জগন্নাথ। জানলে অবাক হতে হয়, জন্ম থেকে তাঁর দুই হাত ছোটো। আর দুটো হাত ছোটো থাকায় তাঁর নাম রাখা হয় জগন্নাথ। এবার সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে পায়ের সাহায্যে লিখে মাধ্যমিক দিচ্ছেন জগন্নাথ (Jagannath) ।
আদিবাসী পাড়া থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছেন একা জগন্নাথই
প্রতিবন্ধকতাকে জয় করার পাশাপাশি প্রতিকূল পরিবেশের মাঝেই এবার পায়ে করে লিখে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছেন মেমারীর সিমলা আদিবাসীপাড়ার বাসিন্দা জগন্নাথ মাণ্ডি। আরও বড় বিষয় এই আদিবাসী পাড়া থেকে জগন্নাথই একমাত্র এবারে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছেন। নুদিপুর ভুপেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যামন্দিরের মাধ্যমিকের ছাত্র জগন্নাথ মাণ্ডির দুটি হাতই প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ জন্মথেকেই। দুটো হাত ছোটো হওয়ায় তাঁর নাম রাখা হয় জগন্নাথ। ছোটোবেলা থেকেই প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে বড় হয়েছে সে। হাত না থাকায় অদম্য জেদ এবং পরিবারের সদস্যদের অনুপ্রেরণাতে হাতের বদলে পা দিয়ে লেখা শুরু করে। মস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে সে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। আগামী দিনে জাতীর সেবায় শিক্ষক হতে চায় এবং তাঁর মতো বিশেষ সক্ষম মানুষদের প্রতিকূলতাকে জয় করার শিক্ষা দিয়ে পাশে দাঁড়াতে চায়।
ছোটোবেলায় হারিয়েছেন মাকেও
ছোটোবেলাটা খুব একটা সুখের নয় জগন্নাথের। মা তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন।ভরসার জায়গা অশতিপর ঠাকুমা, পিসি ও দাদা।পরিবারের সদস্যরা পড়াশুনায় উৎসাহ যোগায় এবং পড়াশোনার খরচ চালায় বাবা ও পিসি। প্রাইমারির গণ্ডী পেড়িয়ে পঞ্চম শ্রেনীতে নুদীপুর ভূপেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যামন্দিরে ভর্তি হয় সে।স্কুলের শিক্ষকরা জানান,পড়াশুনায় খুব ভালো ছেলে। ভালো ফুটবলও খেলার পাশাপাশি পায়ে করে খুব ভালো ছবিও আঁকে জগন্নাথ।তাঁর পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে স্কুলে বসে ক্লাস করার জন্য তাঁর জন্য বিশেষ বেঞ্চের ব্যবস্থা করে স্কুল কতৃপক্ষ। হাতের বদলে পা দিয়েই সে লেখালেখি করে। মাধ্যমিকে তার সিট পড়েছে বাগিলা পূর্ণচন্দ্র স্মৃতি বিদ্যামন্দিরে। জগন্নাথ জানিয়েছে,এখনও পর্যন্ত তার সব পরীক্ষাই ভাল হয়েছে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন তার মত যারা আছে, তাদের উদ্দেশ্যে জগন্নাথের বার্তা,'আমার মত যারা আছে, তাঁরা যেন ভালো করে পড়াশুনা করে। পড়াশোনা চালিয়ে যায়।'
'স্বপ্ন শিক্ষক হওয়ার'
জগন্নাথ জানিয়েছেন, 'তার স্বপ্ন শিক্ষক হওয়ার।' আর এই শিক্ষক হয়ে তার মত যারা আছে তাদের পাশে দাঁড়াতে চায় সে। জগন্নাথের প্রতিবেশী পাশাপাশি সাঁতরা পাড়ার বাসিন্দা সুভাষ সাঁতরা জানিয়েছেন,জগন্নাথ নিজের মনের জোড়ে পড়াশোনা করছে।পাড়ায় ওই একমাত্র মাধ্যমিক দিচ্ছে।তিনি জানিয়েছেন, 'জগন্নাথদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ।জমি- জায়গা নেই। বাবা এবং মা দুজনেই তার কাছে থাকে না।এখন ঠাকুমা ও পিসির কাছে থাকে জগন্নাথ। একমাত্র দাদা অন্য জায়গায় কাজ করে।'
আরও পড়ুন, মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীকে সাপের কামড়, হার না মেনে হাসপাতাল বেডে পরীক্ষা দিলেন ছাত্রী
'ছিল একটিমাত্র প্রাইভেট টিউটর'
'সুভাষবাবু জানিয়েছেন, 'যে কদিন পরীক্ষা হবে তিনিই জগন্নাথকে পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে আসার দায়িত্ব নিয়েছেন। জগন্নাথ জানিয়েছে, গড়ে প্রতিদিন চারঘন্টা পড়াশোনা করেছে। ছিল একটিমাত্র প্রাইভেট টিউটর।' যদিও সে জানিয়েছেন,'স্কুলের শিক্ষকরা তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছে।' পরীক্ষাকেন্দ্র বাগিলা পূর্ণচন্দ্র স্মৃতি বিদ্যামন্দিরের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা অনন্যা তরফদার জানিয়েছেন,'পা দিয়ে জগন্নাথ এত সুন্দর করে লিখছে, প্রত্যেকের ভাল লাগছে। প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এগিয়ে যাচ্ছে এর থেকে অন্যান্যরা অনুপ্রাণিত হবে। পায়ের লেখাও অতি সুন্দর, এবং গুছিয়ে লিখছে। যদিও কী লিখছে সেটা এখন আমাদের দেখার বিষয় নয়। তবে গুছিয়ে লিখছে এটা বোঝা যাচ্ছে।' এখন বাকি পরীক্ষার পাশাপাশি জগন্নাথের পরীক্ষার ফলাফলের দিকেই তাঁকিয়ে রয়েছে গোটা পাড়ার লোকজন।