কমল কৃষ্ণ দে, পূর্ব বর্ধমান:  এমন কিছু ঘটনা , যা প্রকৃতই শতাব্দীকে এগিয়ে নিয়ে যায়।  এমন কিছু উদাহরণ যতদূর বয়ে যায়, ততই সুবাস ছড়ায়। উত্তরণ হয় চেতনার। এ ঘটনা জঙ্গলমহলের। বিয়ে নয়, নাই বা বিদায়বেলা। নতুন বছরে হাসপাতালে আসে রঙিন ফুল দিয়ে সাজানো গাড়ি। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর, কন্যাসন্তানকে হাসপাতাল থেকে এভাবেই বরণ করে গোটা পরিবার।  ব্যান্ড পার্টি বাজিয়ে রাস্তায় মিষ্টি বিলোতে বিলোতে কন্তাসন্তাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন জঙ্গলমহল আউশগ্রামের মন্ডল পরিবার।


কন্যারাও যে আজকের দিনে রত্ন, তাঁরা যে ফেলনা নয়, এই বার্তা দিতে অভিনব উদ্যোগ জঙ্গলমহল আউশগ্রামের মন্ডল পরিবারের। হাসপাতাল থেকে কন্যা সন্তানকে বরণ করলেন তাঁরা। ওদিকে তখন গোটা এলাকায় বাদ্যযন্ত্রের মন ছুঁয়ে যাওয়া সুর। সুসজ্জিত গাড়িতে করে কন্যা সন্তানকে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় হল পুষ্পবৃষ্টি। পরিবার এবং পরিজনদের আনন্দ উচ্ছ্বাসের মাধ্যমে নিয়ে আসা হল বাড়িতে।আর আসার পথে সমগ্র রাস্তা জুড়ে পথচারী ও গ্রামবাসীদের করানো হল মিষ্টিমুখ। কন্যা সন্তান যে ফেলনা নয়,তাঁদেরও একটু ভালোবাসা ও যত্ন নিলে তাঁরাও যে কন্যারত্ন হতে পারে। তাঁরা যে অবহেলার পাত্র নয়,তাঁদেরও পুত্র সন্তানের মতো ভালোবাসা ও সম্মান পাওয়ার অধিকার আছে সমাজকে এই বার্তা দিতেই এই আয়োজন বলে জানান, মন্ডল পরিবারের সদস্যরা। জঙ্গলমহল আউশগ্রামের দেবশালা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রত্যন্ত গ্রাম ধানতোর-এর মন্ডল পরিবারের এই কর্মকান্ডের প্রশংসায় পঞ্চমুখ স্থানীয়রা।


প্রসঙ্গত, ১৮ শতকের গোড়ার দিকে তখনও বাংলায় সতীদাহ প্রথার যবনিকা পড়েনি। কিন্তু এই শতকেই ইতিহাস সবথেকে বড়মাপে সমাজ সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। ১৮২৯ এবং  ১৮৫৬ এই দুটি বছর খুব গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে বঙ্গ সতী প্রবিধান ১৮২৯ (আইন) প্রণয়ন করা হয়। পাশাপাশি ১৮৫৬ বছরটিও ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইশ্চরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় তৎকালীন বড়লাট লর্ড ক্যানিং আইন প্রণয়ন করে বিধবা বিবাহকে স্বীকৃতি দেন। তবে ইতিমধ্যেই পার হয়েছে প্রায় ২০০ বছর। চব্বিশে কোথায় দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা দেশ ? শহর অ়ঞ্চলে ততটা না দেখা গেলেও, গ্রামীণ ভারতে কন্যা সন্তান হত্যা এবং জন্মের পর পরিত্যাগ করার মতো নৃশংস এবং লজ্জাজনক ঘটনার অজস্র উদাহরণ  আজও উঠে আসে প্রকাশ্যে। তবে যা কিছু ভাল, তা চিরকালীন থেকে যায়। বিশেষ করে যখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে একটি প্রত্যন্ত গ্রামে এমন কিছু ঘটে, যা প্রকৃতই শিক্ষা প্রদর্শন করে।


আরও পড়ুন, 'টাকা ছিল না, গলার মটর মালার হার বিক্রি করে কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম', বললেন মমতা


মন্ডল পরিবারের সদস্য কাজল মন্ডল ও শ্যামলী মন্ডলরা জানান,' অনেক ইচ্ছা থাকতেও তিন পুরুষ ধরে তাঁদের পরিবারে কোনও কন্যাসন্তান হয়নি।তিন পুরুষ পর পরিবারে লক্ষ্মীরুপী কন্যা সন্তানের আগমণ যেমন আমাদের কাছে একটা আনন্দের, ঠিক তেমনি সমাজের বুকে কন্যা সন্তান নিয়ে যে অবহেলার বেড়াজাল বিদ্যমান সেই বেড়াজাল কাটিয়ে কন্যারাও যে সামান্য আদর ও যত্ন পেলে তারাও যে এক অমূল্য রত্ন হতে পারে। প্রত্যন্ত জঙ্গলমহলে সেই বার্তা দিতেই আমরা আয়োজন করি এই কর্মযজ্ঞের।এই কর্মযজ্ঞকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং কন্যা সন্তান সম্পর্কে সমাজের অসুররুপী বদ্ধ ধারণাগুলি যাতে পরাস্ত হয়, সেই ভাবনা থেকে নবজাতকের নামও রাখা হয়েছে 'ইভিকা'।'