কলকাতা : ‘আজ মম জন্মদিন। সদ্যই প্রাণের প্রান্তপথে
ডুব দিয়ে উঠেছে সে বিলুপ্তির অন্ধকার হতে
মরণের ছাড়পত্র নিয়ে। মনে হতেছে কী জানি
পুরাতন বৎসরের গ্রন্থিবাঁধা জীর্ণ মালাখানি
সেথা গেছে ছিন্ন হয়ে; নবসূত্রে পড়ে আজি গাঁথা
নব জন্মদিন।’



রুদ্ধ দ্বারের বাইরে দাঁড়ানো অপেক্ষারত বহু মুখ। হাতে রেডিও। সুদূর কলকাতা থেকেও শুনলেন ভক্তরা। কবির ৮০ তম জন্মদিন। টেলিফোন সংযোগে বেতার মাধ্যমে নিজের জন্মদিনে কবি নিজেই শোনালেন তাঁর 'জন্মদিন' কবিতাটি। টেলিফোনে ! ‘জন্মদিন’ কবিতাটির লেখার সময় ও জায়গা হিসেবে রবীন্দ্র রচনাবলীতে ১৩৪৫ সালের ২৫শে বৈশাখ,গৌরীপুর ভবন বলেই উল্লিখিত রয়েছে।

১৩৪৫ সন, ২৫ বৈশাখ। জানা যায়, এর মাধ্যমেই কালিম্পংয়ে টেলিফোন সংযোগ কেন্দ্রের উদ্বোধন হয়েছিল।  বসবার একটি চেয়ার সেই ঘরে আজও সংরক্ষিত। ঝুলবারান্দার উল্টোদিকে কালো হয়ে ওঠা ফায়ারপ্লেস। বহুকাল না রং হওয়া দেওয়াল। অব্যবহারে জন পড়ে যাওয়া দরজার হ্যাজবোল। রঙিন কাচ ভেদ করে রঙিন হয়ে ঢুকে পড়ে পাহাড়ি সূর্যের আলো। ঝুল বারান্দার সামনে উন্নত শির দুই কর্পূর গাছ, কবির হাতে বসানো। সবই আছে, নেই শুধু যত্নের ছাপ। এই বাংলায় অনাদরে পড়ে রবিস্মৃতি।





কালিম্পং শহরে বেড়াতে এসে চিত্রভানুতে অনেকেই যান। রবি-পুত্র রথীন্দ্রনাথের সাধের চিত্রভানু।  কিন্তু রবিস্মৃতিবিজড়িত গৌরিপুর হাউসের খোঁজ অনেকেই রাখেন না। বাড়িটি হেরিটেজ কমিশনের আওতাতেও আসে ২০১৮ সালে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন এই বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সরকার নেয়নি এখনও এই নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। সে চর্চায় পরে আসা যাবে।

কালিম্পং শহর থেকে দক্ষিণ দিকে রিং কিং পিং রোড ধরে এগোলেই গৌরীপুর হাউস। ভরা পর্যটনের মরসুমেও এখানে ভিড়ভাট্টা নেই। বরং একটা গা ছমছমে ভাব আসতে পারে। খুব ডাকাডাকি করলে পাবেন এক মহিলাকে। নাম সঙ্গীতা শর্মা। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, বংশ পরম্পরায় তাঁরা এই বাড়ির কেয়ারটেকার। এখনও সেই কাজটাই করেন। কিন্তু তার জন্য পারিশ্রমিক দেন কে ?বাড়ির মালিক ? সরকার? তাঁর কথায়, পর্যটকদের দেওয়া বখশিসেই চলে। এই বাড়িকে হেরিটাজ ঘোষণা হলেও সরকারি অনুদান আসে না। তাঁরাও কিছু পান না।





সেই মহিলাই বহু যত্নে রোজ এ বাড়ির তালা খোলেন, ঝাঁট দেন। তাঁর জানা কথাগুলিই ভাঙা হিন্দিতে বুঝিয়ে বলেন। তাঁর কথা থেকে জানা গেল, ইদানীং নাকি শুধুমাত্র ছবি তুলতেও আসেন অনেকে ! বা কখনও শুটিংয়ে।

কিন্তু এ বাড়ি কি রবীন্দ্রনাথের ? না। এই বাড়িতে ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৪০ এর মধ্যে বার চারেক কবি এসেছিলেন। মংপুতে তিনি তো থাকতেনই। কিন্তু কালিম্পংয়ের এই বাড়িটি নাকি কিনে নিতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই কালিম্পংয়েই রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য চিত্রভানু। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ নাকি লিজও নেন এই বাড়িটি। তবে বাড়িটির বর্তমান দাবিদার কে, তাই নিয়ে নাকি সংশয় আছে। কারণ এটি সরাসরি ঠাকুর বাড়ির সম্পত্তি নয়।  আদতে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার বাসিন্দা ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বাড়ি এটি। তাঁর বংশের লোকেরাও এখন কে কোথায় আছেন, তা জানা যায় না। ১৯৪০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ শেষবার এই বাড়িতে আসেন। অসুস্থও হয়ে পড়েছিলেন খুব। তখন কলকাতা থেকে তাঁর ঘনিষ্ঠ মানুষরা এসে তাঁকে নামিয়ে নিয়ে যান।  

গ্রীষ্মের সময়ে কয়েকমাস ধরে কয়েকবার কবি এই বাড়িতে থেকেছেন  বলে জানা যায়। এ বাড়িতে একাধিকবার এসেছেন মৈত্রেয়ী দেবী। এসেছেন, কবি ঘনিষ্ঠ আরও বিশিষ্ট জনেরা। এত স্মৃতিকে বুকে আঁকড়ে আজও পাহাড়ের কোলে গৌরিপুর হাউস একা, নিঃসঙ্গ, কিছুটা যেন অভিমানীও !