ভার্চুয়াল দুনিয়ার ভেরিফায়েড সদস্য হওয়ার দায়বদ্ধতা ছিল না। প্রয়োজন ছিল না সমাজের কাছ থেকে বৈধতা পাওয়ারও। কিন্তু ভারতীয় সমাজে নারী যখন আপন ভাগ্য জয় করার অধিকার সম্পর্কে অবগত পর্যন্ত হয়নি, সেই সময়ই নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার বুঝিয়ে দেওয়ার তাগিদ অনুভব করেছিলেন রাজা রামমোহন রায় (Raja Ram Mohan Roy)। ‘দার্শনিক’, ‘মুক্তমনা’, বাংলা নবজাগরণের ‘আদিপুরুষ’, সময়ের সঙ্গে না জানি কতশত উপমা জুড়ে দেওয়া হয়েছে তাঁর নামের পাশে। রক্ত, মাংসের মানুষ ব্যাতীত নিজেকে মহাপুরুষ প্রমাণিত করার কোনও অভিসন্ধি যদিও ছিল না তাঁর। তবে উপমা যদি ব্যবহার করতেই হয়, তাহলে রামমোহনকে ভারতের প্রথম নারীবাদী পুরুষ বলতে হয় (Raja Ram Mohan Roy Birth Anniversary)।  

  


কম্পিউটার, মোবাইল ফোন ছাড়িয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই যুগেও নারীবাদী শব্দটি নিয়ে তো বটেই, নারীবাদী চিহ্নিত হওয়াতেও কুণ্ঠাবোধ করি আমরা। শুধু পুরুষদের দোষারোপ করেই বা কী হবে, সমাজে খ্যাতি প্রতিষ্ঠা রয়েছে, এমন মেয়েও নারীবাদী পরিচিতিতে আপত্তি রয়েছে। কিন্তু নারীবাদী হওয়ার অর্থ যে স্ত্রী জাতির কর্তৃত্ব স্বীকার নয়, বরং যুগ যুগ ধরে পিতৃতন্ত্রের পদতলে দলিত হওয়া স্ত্রী জাতিকে প্রাপ্য অধিকার প্রদান করা, সমাজে নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করা, তা সেই যুগেই বুঝেছিলেন রামমোহন। তাই দু’কলম লিখে দায়িত্ব সারেননি তিনি। ভারতীয় মেয়েদের প্রাপ্য অধিকার বুঝিয়ে দিতে উদ্যোগী হয়েছিলেন নিজে থেকেই। সেই যুগে সমাজের চোখে চোখ রেখেই সেই কাজ করতে হয়েছিল তাঁকে (Raja Ram Mohan Roy, the First Feminist)। 


হুগলি জেলার সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম রাজা রামমোহনের। মাত্র ১২ বছর বয়সে পটনার মৌলবির কাছে আরবি, ফার্সি শিক্ষা। সংস্কৃত, ইংরেজি, গ্রিক, হিব্রু ভাষাও জানতেন। প্রজ্ঞাসন্ধানী হতে তিব্বতি পুঁথি পর্যন্ত মুখস্থ করে ফেলেন। তাই বলে দূরে ঠেলে দেননি দর্শন এবং বিজ্ঞানকে। মূর্তিপুজো বিরোধী, একেশ্বরবাদী রামমোহন সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখেননি কোনও ধর্মকেই। তবে নারীকে প্রাপ্য অধিকার পাইয়ে দিতে লড়াই শুরু নিজের ভিটে থেকেই। কথায় বলে, ‘আগে ঘর, তবে পর’। রামমোহনকে বিরাট ধাক্কা খেতে হয়েছিল নিজের বাড়িতেই। চোখের সামনে দাদার চিতায় উঠে মৃত্যুবরণ করতে দেখেছিলেন বৌদিকে, সেই ভয়াবহতাই নারীর বিরুদ্ধে অন্যায়, অত্যাচার এবং অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে তোলে তাঁকে। 


১৮১১ সালে রামমোহনের দাদা জগন্মোহনের মৃত্যু হয়। অল্প বয়সেই মারা যান জগন্মোহন। তাঁর স্ত্রী অলকামঞ্জরীও তখন যুবতী। স্বামীর মৃত্যুতে কনের বেশে সাজানো হয় অলকামঞ্জরীকে। তার পর চিতায় তুলে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। আপ্রাণ চেষ্টা করেও সেই সময় বৌদিকে বাঁচাতে পারেননি রামমোহন। চোখের সামনে দেখেছিলেন, দাউদাউ করে জ্বলছে চিতানল। তার মধ্যে গাত্রোত্থানের চেষ্টা করছেন অলকামঞ্জরী। তাঁর আর্তনাদ ঢাকতে প্রবল উদ্যমে বেজে চলেছে বাদ্যভাণ্ড। সেই দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে দগ্ধ হয়ে গিয়েছিল রামমোহনের হৃদয়ও। নারীর সতীত্বরক্ষার দোহাই দিয়ে যুগ যুগ ধরে চলে আসা নৃশংস ওই কুপ্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন সেই মুহূর্ত থেকেই।


সতীদাহের বিরুদ্ধে কলম ধরে ‘সহমরণ বিষয় প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ’ রচনা করেন রামমোহন। প্রশ্নত্তোরের আকারে তাঁর সেই লেখা প্রকাশিত হয় ১৮১৮ সালে। সরাসরি তাতে মনুস্মৃতির ভুল ব্যাখ্যা তুলে ধরেন তিনি। স্পষ্ট ভাষায় বুঝিয়ে দেন, স্বামীর মৃত্যুতে নারীর মুক্তিলাভের পথ বাতলে দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্রহ্মচর্য পালনের কথা বলা হয়েছে মনুস্মৃতিতে, সহমরণের উল্লেখ নেই। সকল স্মৃতি পুরাণ ইতিহাসের সার ‘ভগবদ গীতা’ থেকে একটি উদ্ধৃতিও নিজের লেখায় যুক্ত করেন রামমোহন, যা হল— ‘যামিমাং পুষ্পিতাং বাচং প্রবদন্ত্যবিপশ্চিতঃ। বেদবাদরতাঃ পার্থ নান্যদস্তীতি বাদিনংঃ। কামাত্মানঃ স্বর্গপরা জন্মকর্ম্মফলপ্রদাং। ক্রিয়াবিশেষ বহুলাং ভোগৈশ্বর্য্যগতিং প্রতি॥ ভোগৈশ্বর্য্যপ্রসক্তানাং তয়াপহৃতচেতসাং॥ ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিঃ সমাধৌ ন বিধীয়তে॥’ 


‘ভগবদ গীতা’র ওই উদ্ধৃতির অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রামমোহন লেখেন, ‘যে সকল মূঢ়েরা বেদের ফলশ্রবণবাক্যে রত হইয়া আপাতত প্রিয়কারী যে ওই ফলশ্রুতি তাহাকেই পরমার্থ সাধক করিয়া কহে, আর কহে যে ইহার পর অন্য ঈশ্বরতত্ত্ব নাই, ওই সকল কামনাতে আকুলিচিত্ত ব্যক্তিরা দেবতাস্থান যে স্বর্গ তাহাকে পরমপুরুষার্থ করিয়া জানে, আর জন্ম ও কর্ম তাহার ফল প্রদান করে এবং ভোগ ঐশ্বর্যের প্রলোভ দেখায় এমতারূপ নানা ক্রিয়াতে পরিপূর্ণ যে সকল বাক্য আছে এমৎ বাক্যসকলকে পরমার্থসাধন কহে। অতএব ভোগৈশ্বর্যেতে আসক্তচিত্ত এমৎরূপ ব্যক্তি সকলের পরমেশ্বরে চিত্তের নিষ্ঠা হয় না’। 


লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর তৎকালীন বঙ্গসমাজে আলোড়ন পড়ে যায়। কার্যত একঘরে হয়ে পড়েন রামমোহন। তাঁর লেখার প্রত্যুত্তরে ‘বিধায়তক নিষেধকের সম্বাদ’ রচনা করেন কাশীনাথ তর্কবাগীশ। সতীদাহ প্রথা শাস্ত্রবিরোধী নয়, স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী প্রকৃষ্টরূপে নিজেকে দাহ না করলে, মুক্তি মেলে না বলে পাল্টা দাবি করেন তিনি। এর পাল্টা ১৮১৯ সালে ‘সহমরণ বিষয়ে প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ’ লেখেন রামমোহন। পরে সেটি ইংরেজিতে অনুবাদও করেন। এর প্রায় একদশক পর ইংরেজ শাসকের প্রতিনিধি হয়ে উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের আগমন কলকাতায়। একে একে রাধাকান্ত দেব, হরিমোহন ঠাকুরদের আগমন। সতীদাহ প্রথা রদে তৎকালীন ইংরেজ সরকারের সিলমোহর জোগাড় করতে এর পর ইংল্যান্ড যাত্রা রামমোহনের। সম্রাট দ্বিতীয় আকবর ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করে ইংল্যান্ড পাঠান তাঁকে। অর্থসাহায্য করেছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরও। তার পর ১৮২৯ সালে সতীদাহ রদে সিলমোহর পড়ে তৎকালীন ইংরেজ শাসকের। 


রামমোহনের নারীভাবনার একমাত্র উদাহরণ সতীদাহ রদ ভাবলে মস্ত ভুল হবে। তৎকালীন বঙ্গসমাজে মেয়েদের অবস্থান, মেয়েদের শিক্ষার সুযোগে অভাব নিয়েও অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি। নারী মানেই অল্পবুদ্ধি, বিশ্বাসের অযোগ্যা, অস্থিরান্তঃকরণ, ধর্মজ্ঞানশূন্যা, এই ধারণারও ঘোর বিরোধী ছিলেন রামমোহন। তাই লেখাতেই জবাব দেন, ‘স্ত্রীলোকের বুদ্ধির পরীক্ষা কোন কালে লইয়াছেন, যে অনায়াসেই তাহারদিগকে অল্পবুদ্ধি কহেন? কারণ বিদ্যাশিক্ষা এবং জ্ঞানশিক্ষা দিলে পরে ব্যক্তি যদি অনুভব ও গ্রহণ করিতে না পারে, তখন তাহাকে অল্পবুদ্ধি কহা সম্ভব হয়; আপনারা বিদ্যা শিক্ষা জ্ঞানোপদেশ স্ত্রীলোককে প্রায় দেন নাই। তবে তাহারা বুদ্ধিহীন নয় ইহা কীরূপে নিশ্চয় করেন. বরঞ্চ লীলাবতী, ভানুমতী, কর্ণাট রাজার পত্নী; কালিদাসের পত্নী প্রভৃতি যাহাকে বিদ্যাভ্যাস করাইয়াছিলেন, তাহারা সর্বশাস্ত্রের পারগরূপে বিখ্যাতা আছে, বিশেষত বৃহদারণ্যক উপনিষদে ব্যক্তই প্রমাণ আছে, অত্যন্ত দুরূহ ব্রহ্মজ্ঞান তাহা যাজ্ঞবল্ক্য আপন স্ত্রী মৈত্রেয়ীকে উপদেশ করিয়াছেন, মৈত্রেয়ীও তাহার গ্রহণপূর্বক কৃতার্থ হয়েন’।


স্বামীর ঘরই যে মেয়েদের সর্বস্ব নয়, পিতৃগৃহ হোক বা স্বামীগৃহ, মেয়েদের পরাধীনতার আগল ভেঙে আসা যে প্রয়োজন, তা উপলব্ধি করেছিলেন রামমোহন। তাই লিখেছিলেন, ‘...স্ত্রীলোকের মধ্যে অনেকেই ধর্মভয়ে স্বামীর সহিত সাক্ষাৎ ব্যাতিরেকেও এবং স্বামী দ্বারা কোনও উপকার বিনাও পিতৃগৃহে অথবা ভ্রাতৃগৃহে কেবল পরাধীন হইয়া নানা দুঃখ সহিষ্ণুতাপূর্বক থাকিয়াও যাবজ্জীবন ধর্ম নির্বাহ করেন; আর ব্রাহ্মণের অথবা অন্য কোনও বর্ণের মধ্যে যাঁহারা আপন পন স্ত্রীকে লইয়া গার্হ্যস্থ করেন, তাঁহাদের বাটীতে প্রায় স্ত্রী লোক কী কী দুর্গতি না পায়? বিবাহের সময় স্ত্রীকে অর্থ অঙ্গ করিয়া স্বীকার করেন; কিন্তু ব্যবহাররে সময় পশু হইতে নীচ জানিয়া ব্যবহার করেন; যেহেতু স্বামীগৃহে প্রায় সকলের পত্নী দাস্যবৃত্তি করে, অর্থাৎ অতি প্রাতে কী শীতকাল কী বর্ষাতে স্থান মার্জন, ভোজনাদি পাত্র মার্জন, গৃহলেপনাদি তাবৎ কর্ম করিয়া থাকে; এবং সুপকারের কর্ম বিনা বেতনে দিবসে ও রাত্রিতে করে, অর্থা স্বামী শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামীর ভ্রাতৃবর্গ আমার্ত্যবর্গ, এ সকলের রন্ধন পরিবেশনাদি আপন আপন নিয়মিতকালে করে...’।


বাঙালির হেন কোনও আবেগ ছুঁয়ে যেতে বাকি রাখেননি যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তিনিও রামমোহনের এই নারীভাবনা, যুগের থেকে এগিয়ে থাকার মানসিকতাকে এড়িয়ে যেতে পারেননি। তাই লিখেছিলেন, ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার, কেন নাহি দিবে অধিকার...’। রামমোহন যুগের থেকে কতটা এগিয়েছিলেন তা যথার্থই ঠাহর করেছিলেন গুরুদেব। তাই রামমোহন তাঁর কাছে ছিলেন ‘ভারতপথিক’। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,  ‘...অর্থহারা আচারের স্বপ্নজালে জড়িত ভারতবর্ষ; তার আলো এসেছিল নিবে। তার আপনার কাছে আপন সত্যপরিচয় ছিল আচ্ছন্ন। এমন সময় রামমোহন রায়ের আবির্ভাব হল এই দেশে, সেই আত্মবিস্মৃত প্রদোষের অন্ধকারে’। অন্ধকার যে একেবারে কেটে গিয়েছে, নারী-পুরুষ সাম্য বেঁধে রেখেছে সমাজকে, আজকের দিনে দাঁড়িয়েও বুক ঠুকে দাবি করতে পারবেন না কেউ। আর সেই কারণেই এত বছর বছরও প্রসঙ্গিক থেকে গিয়েছেন নারীবাদী রামমোহন এবং তাঁর নারীভাবনা।