কলকাতা: টাটারা পাততাড়ি গুটিয়ে নেওয়ার পর নয় নয় করে কেটে গিয়েছে দেড় দশক। কিন্তু এত বছর পরও বঙ্গ রাজনীতিতে ঘুরে ফিরে উঠে আসছে সিঙ্গুর প্রসঙ্গ। তাতে নয়া সংযোজন আরবিট্রাল ট্রাইব্যুনালের রায় (Tata Compensation)। সিঙ্গুরে কারখানা না হওয়ায় টাটাকে সুদ-সহ ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছে তারা। সেই নিয়ে নতুন করে দোষারোপ, পাল্টা দোষারোপের পালা শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে দীর্ঘ উথালপাতালের ইতিহাসও ফিরে আসছে স্মৃতিতে। 


২০০৬ সালের ১৮ মে বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আর সেই দিনই মধ্যবিত্তের জন্য কম খরচে, ছোট চারচাকার গাড়ি তৈরি করতে সিঙ্গুরে কারখানা গড়ার কথা ঘোষণা করেন শিল্পপতি রতন টাটা। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার প্রথমে ১০১৩ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেয়, পরে ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জুলাই মাসে জমি অধিগ্রহণের লক্ষ্যে ১৩টি বিজ্ঞপ্তি জারি করে তৎকালীন বাম সরকার। (Singur Land Case)


কিন্তু জমি অধিগ্রহণ ঘিরে চারপাশ থেকে অসন্তোষের আঁচ টের পাওয়া যায়। জোর করে জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তার বিনিময়ে ন্যায্য টাকাও মেলেনি বলে আন্দোলনে নামেন কৃষকরা। সেই সময় সিঙ্গুর ব্লক প্রশাসনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, এলাকার ৮৩ শতাংশ জমি সেচযোগ্য এবং উৎপাদিত ফসলের ঘনত্ব প্রায় ২২০ শতাংশ। মূলত ধান এবং আলুচাষ হলেও, সবুজ শাক-সবজিরও চাষ হয়। তাই শিল্প গড়তে বেছে বেছে হুগলি জেলার চাষযোগ্য, বহুফসলি উর্বর জমিকেই কেন বেছে নেওয়া হল, অন্যত্র কেন জমির বন্দোবস্ত করা হল না, ওঠে সেই প্রশ্নও। বিক্ষিপ্ত সেই আন্দোলন জোর পায় রাজ্যের তৎকালীন বিরোধী দল তৃণমূলের সমর্থনে। প্রায় ৬০০০ কৃষক পরিবারকে একজোট করে আন্দোলনকে মজবুত করে তোলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিঙ্গুর থেকে সরিয়ে টাটাদের অন্যত্র জমি দিতে হবে বলে দাবি তোলেন তিনি। 




ছবি: তৃণমূলের ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত।


এর পর যত সময় এগোতে থাকে, আন্দোলনের পরিধির বিস্তার ঘটে ততই। সিঙ্গুরে বিডিও অফিসের সামনে থেকে আন্দোলনরত মমতাকে তুলে দেওয়া নিয়ে ধুন্ধুমার বেধে যায়। সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনের রেশ শুধুমাত্র বাংলা বা দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, আন্তর্জাতিক স্তরেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। সিঙ্গুরে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের তরফে সমীক্ষা চালানো হয়। কৃষকদের জোর করে উচ্ছেদ করা নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করে তারা। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিশনের কাছেও বিষয়টি তুলে ধরা হয়। আন্দোলনকারীদের প্রতি পুলিশের নৃশংস আচরণের বিরুদ্ধেও গর্জে ওঠেন বাংলার সাধারণ মানুষ থেকে বিশিষ্টজনেরা। সমাজকর্মী মেধা পটেকর, মহাশ্বেতা দেবী, বিচারপতি মলয় সেনগুপ্ত, বিচারপতি দীপঙ্কর সেনগুপ্তের মতো ব্যক্তিও কৃষকদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। 


টাটারা জমি ঘিরতে শুরু করলে, ২০০৬ সালের ৪ ডিসেম্বর কলকাতার ধর্মতলায় টানা ২৬ দিনের অনশনে বসেন মমতা। সেই সময় মমতার পাশে দাঁড়িয়েছিল বিজেপি। অনশনমঞ্চে মমতার পাশে দেখা গিয়েছিল রাজনাথ সিংহকে। সিঙ্গুর আন্দোলনে ছায়াসঙ্গীর মতো মমতার পাশে নিরন্তর ছিলেন শুভেন্দু অধিকারীও, বর্তমানে যিনি বিজেপি-তে এবং আরবিট্রাল ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর লাগাতার মমতাকে বিঁধে চলেছেন। বাংলায় শিল্পের যাবতীয় সম্ভাবনা মমতা ধ্বংস করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ তুলছেন। 


আরও পড়ুন: Onion Price Hike : পেঁয়াজের দাম এক লাফে দ্বিগুণ, মাথায় হাত ক্রেতাদের, কী বলছেন কলকাতার ব্যবসায়ীরা ?


মমতার পাশাপাশি, ওই একই সময়ে সিঙ্গুরে কৃষকদের একাংশও অনশন শুরু করেন। কলকাতায় মমতার অনশন মঞ্চ ঘিরে উপচে পড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়। সভা-বক্তৃতার মাধ্যমে জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করা হয়। ওই সভায় গোপালকৃষ্ণ গাঁধী, মহাশ্বেতাদেবী, অম্লান দত্ত, সন্তোষ ভট্টাচার্য, ভিপি সিংহ, মেধা পটেকর, দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, সুমিত্রা কুলকার্নি, প্রফুল্ল মোহান্ত, প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি, জর্জ ফার্নান্ডেজ,  রাজনাথ সিংহ, কাশীকান্ত মৈত্র, সইফুদ্দিন চৌধুরী, হারাধন রায়, সুনন্দা সান্যাল, জয়া মিত্র, প্রতুল মুখোপাধ্যায়, কবীর সুমন, সুজাত ভদ্ররাও উপস্থিত ছিলেন।
এর চার দিন পর, সিঙ্গুর যাওয়ার পথে আটকানো হয় মেধা পটেকরকে। আটক করা হয় তাঁকে।  জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে দোকানপাট বন্ধ রেখে আন্দোলনে যোগ দেন সাধারণ মানুষজন। ২০০৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর টাটাদের ঘেরা জায়গায় সিঙ্গুর কৃষি জমি রক্ষা সমিতির সদস্য তাপসী মালিকের অগ্নিদগ্ধ দেহ উদ্ধার হয়। ধর্ষণের পর খুন করে তাঁকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে। তদন্তভার ওঠে সিবিআই-এর হাতে। ২৮ ডিসেম্বর এপিজে আব্দুল কালাম, মনমোহন সিংহ, অটলবিহারি বাজপেয়ীরা মমতাকে অনশন শেষ করতে আর্জি জানিয়ে চিঠি পাঠান। শেষ মেশ ২৯ ডিসেম্বর, ২৫ দিন পর অনশন ভঙ্গ করেন মমতা।


সেই পরিস্থিতিতেই ২০০৭ সালে সিঙ্গুরে কারখানা তৈরির কাজে হাত দেয় টাটারা। কিন্তু শিল্পের জন্য জমি দেওয়া কৃষকদের নামের তালিকায় গরমিল রয়েছে বলে অভিযোগ করে তৃণমূল, পরে যা মেনে নেয় তৎকালীন বাম সরকার। সিঙ্গুরের কৃষকরাও ফের সরব হন। অভিযোগ করেন, জল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তাঁদের। ফলে গোপালনগর, বেড়াবেরি, খাসেরবেড়ি, সিংহেরবেড়ির ৭৪৩ একর চাষের জমিতে চাষের কাজ করা যাচ্ছে না। সে বছর ৪ জুন মমতাকে ফোন করেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। সিঙ্গুর নিয়ে আলোচনায় বসতে আহ্বান জানান।   




ছবি: তৃণমূলের ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত।


২০০৮ সালের ২৮ মে মমতা জানান, সিঙ্গুরে টাটাদের কারখানা তৈরিতে কোনও আপত্তি নেই তাঁর। কিন্তু অনিচ্ছুক কৃষকদের ৪০০ একর জমি ফিরিয়ে দিতে হবে সরকারকে। মমতা বলেন, “আবারও বলছি, আমরা শিল্পের বিরোধী নই। শিল্প আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” সেই পরিস্থিতিতে মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসেন রাজ্যের তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী। ২০ অগাস্ট রাজভবনে মমতা এবং বুদ্ধদেবের মধ্যে বৈঠক হয়। সেখানে অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি তোলেন মমতা। কিন্তু দীর্ঘ ক্ষণ ধরে চলা সেই বৈঠক ব্যর্থ হয়। ২৪ অগাস্ট ফের সিঙ্গুর হাইওয়ের উপর অবস্থান বিক্ষোভ শুরু মমতার।  


এর পর ৩ অক্টোবর সিঙ্গুর ছাড়ার কথা ঘোষণা করেন রতন টাটা। তিনি বলেন, “বন্দুক ঠেকালেও যাব না বলেছিলাম। কিন্তু মমতা ট্রিগার টিপে দিলেন! মমতার জন্যই সিঙ্গুর ছাড়লাম।” এর পর ২০১১ সালে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন মমতা। তাঁর ক্ষমতাদখলের নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সিঙ্গুরের। ক্ষমতায় এসে তাই প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকেই সিঙ্গুরে জমি ফেরানোর সিদ্ধান্ত নেয় মমতার  সরকার। সুপ্রিম কোর্ট বাম আমলের জমি অধিগ্রহণকে অবৈধ বলে রায় দেওয়ার পর, ২০১৬ সালে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে, সিঙ্গুরের কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেন তিনি। 


কিন্তু সিঙ্গুর সমস্যা মেটেনি। সিঙ্গুর থেকে সরে যাওয়ায় যে ক্ষতির মুখে পড়তে হয় তাদের, তার জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল টাটারা। তারা জানায়, সিঙ্গুর থেকে কারখানা গুজরাতে সরিয়ে নিয়ে যেতে ১২৪৬ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয় তাদের। সেই টাকা বাদ দিলেও, সিঙ্গুরে জমির মূল্যবাবদ ১৫৪ কোটি টাকা রাজ্য সরকারকে দিয়েছিল তারা। সেই টাকা রাজ্য সরকারকে ফেরত দিতে হবে বলে দাবি জানায় টাটারা। টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয় মমতা সরকার। তার পরিবর্তে টাটাদের অন্যত্র জমি দিতে প্রস্তুত বলে জানানো হয়। ২০১৬ সালে ‘সিঙ্গুর দিবসে’র ভাষণে তার উল্লেখও করেন মমতা। জানান, টাটাদের সঙ্গে তিক্ততা চায় না রাজ্য। রাজ্যের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র বলেন, “সিঙ্গুরের বিকল্প জমি রয়েছে আমাদের হাতে। গোয়ালতোড়ে ১ হাজার একর জমি রয়েছে। রঘুনাথপুরেও জমির বন্দোবস্ত করা হয়েছে। টাটারা আগ্রহী হলে আলোচনায় বসতে পারি।” 


এর পাশাপাশি খড়্গপুর, পানাগড়েও জমি দেওয়া যেতে পারে বলে জানায় রাজ্য। কিন্তু ক্ষতিপূরণের দাবি থেকে সরেনি টাটারা। টাটা মোটরসের তরফে জানানো হয়, সিঙ্গুরে  কারখানা না হওয়ায় তাদের সুদসহ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে ওয়েস্ট বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড বা WBIDC-কে। তাতেই সিলমোহর দিয়েছে আরবিট্রাল ট্রাইব্যুনাল। সুদ-সহ টাটাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে তারা। সুদ ছাড়াই ক্ষতিপূরণের সেই অঙ্ক ৭৬৫ কোটি ৭৮ লক্ষ টাকা বলে জানানো হয়েছে। টাটা-র তরফে জানানো হয়েছে, ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে পুরো ক্ষতিপূরণ পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত ১১ শতাংশ হারে সুদও দিতে বলা হয়েছে রাজ্য সরকারকে। যত দিন পর্যব্ত না ক্ষতিপূরণ মেটানো হবে, তত দিন পর্যন্ত গুণে যেতে হবে সুদ। ২০১৬ সাল থেকে হিসেব করলে, এই সাত বছরে মূল টাকার উপর ১১ শতাংশ হারে সুদ গুণতে হবে, তাতে টাকার অঙ্ক হচ্ছে ১৩০০ কোটি টাকা প্রায়। এর পাশাপাশি, মামলার খরচের জন্য আরও ১ কোটি টাকা দিতে হবে WBIDC-কে। ট্রাইব্যুনালের এই নির্দেশকে রাজ্য সরকার চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।