কলকাতা : নবমীর ভোরে তিনি নেই৷ সালটা ছিল ২০১২। দুর্গাপুজোর সকাল এমন শূন্যতা বোধ হয় তার আগে দেখেনি এ শহর।  দিকশূন্যপুরে চলে গিয়েছিলেন নীললোহিত ৷ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।  সময় তার অতল গহ্বরে টেনে নেয় 'সেই সময়'-এর স্রষ্টাকে৷ 


দিনটা ছিল মঙ্গলবার । হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ৷ বাংলা সাহিত্যকে যেন একেবার পিতৃহারা করে দিয়ে উত্সবের শহরকে কার্যত শোকনগরী করে দেয় সুনীলের মৃত্যু ৷ সে ছিল বড় বিষণ্ণ এক নবমীর সকাল৷ তারপর কেটে গিয়েছে এতগুলো বছর। সুনীলহীন বাংলা সাহিত্য। সুনীলহীন পুজো সংখ্যা। তবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চলে যাওয়া যাঁদের কাছে একেবারে ব্যক্তিগত ক্ষতি, তাঁদের মধ্যেই একজন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় । 


একদা বন্ধু,পরে সহকর্মী মানুষটির সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ফিরে গেলেন সেই কফি হাউসের দিনগুলিতে। তখন তিনি এমএ ক্লাসের ছাত্র। সুনীল সম্ভবত পাশ করে গিয়েছেন। কফি হাউসেই প্রথম আলাপ। আড্ডা জমত সেখানেই। তখন সুনীল গদ্য লিখতেন না। কবিতাই লিখতেন। কৃত্তিবাস পত্রিকা চালাতেন। টিউশন পড়াতেন প্রচুর। সংসার ছিল টানাপোড়েনের। এবিপি লাইভের সঙ্গে কথোপকথনে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বললেন, ' তখন আমাদের সকলেরই আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল। সুনীল খুব সংগ্রামী, লড়াকু মানুষ ছিলেন। তবে সবকিছুর মধ্যে  তাঁর একটা নির্বিকার ভাব ছিল, যে কোনও পরিস্থিতিতে। ওরকম বড় হৃদয়ের মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। অসাধারণ একটি হৃদয় ছিল ওঁর। স্নেহসিক্ত , দয়ালু, পরদুঃখকাতর। মানুষ হিসেবে অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন। যে ওঁকে চিনত ভালবেসে ফেলত। আমাদের বন্ধুত্ব বেশ প্রগাঢ়ই ছিল। আমি তো দীক্ষা নিলাম। মদ্যপানের অভ্যেস চলে গেল। তখন সব জমায়েতে আর দেখা হত না আমাদের।'


পরবর্তীতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এক সময় ঘুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু থেকে সহকর্মী হয়ে যান দেশ-পত্রিকায় কাজ করার সুবাদে। অফিসের পরও সুদীর্ঘ আড্ডা চলত তাঁদের। কখনও সেই আড্ডায় থাকতেন জয় গোস্বামীও। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথায়, 'বিভিন্ন জায়গায় একসঙ্গে গিয়েছি, বহু স্মৃতি। বাংলার বিভিন্ন জায়গা থেকে বিদেশ। এত গাঢ় সম্পর্ক কিন্ত আপনিই বলে গিয়েছি একে অপরকে। কোনও দিন তা তুই বা তুমিতে নামেনি।  একই সঙ্গে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা মেশানো। পরবর্তীতে যখন দেখলাম সুনীল অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, মোটা হয়ে যাচ্ছেন, হাত-পা কাঁপছে, খারাপ লাগত খুব। ওঁকে সাবধানও করেছিলাম। একবার ওঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দেখলাম ওঁর হাতটা কাঁপছে। আমি ওঁর হাতটা ধরে বললাম। আপনি নিজের যত্ন নিন, আপনি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করুন। এত মানুষ আপনাকে ভালবাসে। উনিও আমার হাতটা চেপে ধরেছিলেন। বড্ড খারাপ লেগেছিল'


'২০১২ সালে নবমীর সকালে ওঁর চলে যাওয়ার সংবাদটা এল বজ্রাঘাতের মতো। সুনীলের চলে যাওয়াটা তো সাহিত্য জগতের শূন্য়তা নয়...আমার ব্যক্তিগত জীবনের শূন্যতা। সুনীল চলে গিয়েছেন,শক্তি নেই, অতীন চলে গিয়েছে, সিরাজ চলে গিয়েছেন। এই যে এত এত চলে যাওয়া...সমরেশও চলে গেল...একদিন সকলকেই চলে যেতে হবে। তবে সুনীল একটু তাড়াতাড়ি চলে গেল। সবাইকার তো একদিন না একদিন কলম থামবেই।' 


‘প্রথম আলোয়’ আলোকিত করেছেন দেশের সাহিত্যকে ৷ বাংলা সাহিত্যজগতের সেই সম্রাট নেই প্রায় এক যুগ হতে চলল।  কিন্তু এখনও বাঙালির শৈশব-কৈশোর-যৌবন-বার্ধক্য মজছে সুনীলে।