উত্তর দিনাজপুর: পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বৈচিত্র্যময় একটি জেলা উত্তর দিনাজপুর (Uttar Dinajpur)। একের পর এক সাম্রাজ্যের ঝড়জল পেরিয়ে, স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েও শেষ পর্যন্ত দুই অংশে ভাগ হয়ে যায় দিনাজপুর। যার পশ্চিমাংশ (Western Part) থেকে যায় ভারতে (India)। পূর্ববর্তী সেই পশ্চিম দিনাজপুর জেলা ফের বিভক্ত হয়ে ১৯৯২ সালের ১ এপ্রিলে অধুনা উত্তর দিনাজপুর জেলা তৈরি হয়। এই জেলা দুটি মহকুমা নিয়ে গঠিত, রায়গঞ্জ (Raigunj) এবং ইসলামপুর (Islampur)।
ইতিহাস
বহু পুরনো এই জেলার ইতিহাস শুরু হয় যখন অবিভক্ত দিনাজপুর জেলা পুন্ড্র রাজ্যের অংশ ছিল, সেই সময় থেকে। এই পুরো পুন্ড্র, মৌর্য সাম্রাজ্যের অংশ ছিল এবং খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে এই অঞ্চলে জৈন ধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল। তাদের রাজধানী ছিল 'পুন্ড্রবর্ধন' (যা অধুনা বাংলাদেশে), এবং আরও দুই প্রাচীন শহর গৌড়পুর ও কোটিবর্ষ, এখন যার নাম বানগড়। এর পরবর্তীকালে পুন্ড্র অঞ্চলের ক্ষমতায় আসে গুপ্তরাও। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে এই জেলা ছিল পাল শাসনের অধীনে। সেন বংশ এসে পাল সাম্রাজ্যকে উৎখাত করে ১১৪৩ সালে। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজি এসে সেনদের পরাজিত করেন এবং বানগড়কে নিজের রাজধানী বানান। তাঁর হত্যার পর, এই অঞ্চল গৌড় থেকে দিল্লির সুলতানের পাঠানো বিভিন্ন গভর্নর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ১৫৮৬ সালে, বাংলা জয় করেন আকবর, এবং তাজপুর ও পাঞ্জরের সরকার দিনাজপুরের দায়িত্ব পায়। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অধীনে চলে যায় এবং মুর্শিদাবাদ থেকে নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে থেকে উনবিংশ শতকের প্রথমাংশ পর্যন্ত এই জেলা সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের আবাসস্থল ছিল। অষ্টাদশ শতকের বাকি অংশ মোটামুটি শান্তিপূর্ণই ছিল এই গোটা জেলা। স্বাধীনতা সংগ্রাম, বঙ্গভঙ্গের আঁচও পড়ে এখানে। ১৯০৫ সালে দিনাজপুরের বাসিন্দারা বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে সামিল হন। তাঁরা কর দিতে অস্বীকার করে, হরতাল করে, আন্দোলন করে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ১৯৪৭ সালে, দিনাজপুর জেলা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়, এবং পশ্চিমাংশ ভারতের মধ্যে রয়ে যায়।
অবস্থান
১৯৯২ সালের ১ এপ্রিল, তৎকালীন পশ্চিম দিনাজপুর ভেঙে তৈরি হয় উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর। জেলাটি ২৫ ডিগ্রি ১১ মিনিট উত্তর থেকে ২৬ ডিগ্রি ৪৯ মিনিট উত্তর অক্ষাংশের মধ্যে এবং ৮৭ ডিগ্রি ৪৯ মিনিট পূর্ব থেকে ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। এর বিস্তার ৩১৪২ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে। এর পূর্বে বাংলাদেশের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁ ও দিনাজপুর জেলা, পশ্চিমে বিহার, উত্তরে দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলা এবং দক্ষিণে মালদা ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা রয়েছে।
ভূ-পরিচয়
এই জেলার আঞ্চলিক অবস্থান সাধারণত সমতল, তবে খানিক দক্ষিণ ঢাল আছে। যার দিকে কুলিক, নগর, মহানন্দা ইত্যাদি প্রধান নদী প্রবাহিত হয়। জেলাটি পূর্বে রাজমহল পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত অববাহিকার একটি অংশ গঠন করে। অনুমান করা হয় এখানের প্রাচীন পলিমাটি প্লাইস্টোসিন যুগের। স্বভাবতই উত্তর দিনাজপুরের জমি প্রচণ্ড উর্বর। ক্রমাগত পলি সঞ্চয়ের ফলে এখানের মাটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ যা ধান, পাট, মেস্তা ও আখ ইত্যাদি উৎপাদনে সাহায্য করে। এখানে আর্দ্র-ক্রান্তীয় ও শুষ্ক জলবায়ু দেখা যায় সাধারণত।
অর্থনীতি
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর উত্তর দিনাজপুর জেলার অর্থনীতির মূলে কৃষিকাজ। গুটিকয়েক ব্যবসায়ী ও চাকুরিজীবী ছাড়া এখানের সাধারণ মানুষের জীবন মূলত কৃষিনির্ভর। ধান, পাট, ভুট্টা ও আনারসের ফলন এখানে সবচেয়ে বেশি।
রাজনীতি
পশ্চিমবঙ্গে বাকি জেলাগুলির মতোই উত্তর দিনাজপুরও বর্তমানে ঘাসফুল শিবিরের দখলে। এই জেলায় রয়েছে একটি মাত্র লোকসভা কেন্দ্র, রায়গঞ্জ। এখানের চোপড়া বিধানসভা রয়েছে দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রের অধীনে। এই জেলার ৯টি বিধানসভা কেন্দ্রের প্রত্যেকটিই শাসকদলের। শেষ বিধানসভা নির্বাচনে শুধুমাত্র রায়গঞ্জ ও কালিয়াগঞ্জ থেকে বিজেপি জেতে। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই দুই অঞ্চলের বিজেপি নেতাও পদ্মশিবির ছেড়ে চলে আসেন তৃণমূলে। ফলে এখন সব বিধানসভা কেন্দ্রই তৃণমূলের অধীনে। এ তো গেল বর্তমান সময়ের কথা, কিন্তু অতীতে এই অঞ্চল প্রবাদপ্রতিম কংগ্রেস নেতা এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সীর আমলে কংগ্রেসের দুর্গ বলেই পরিচিত ছিল। দীর্ঘ সময় ধরে কংগ্রেস ও বামেদের আধিপত্যই ছিল বেশি। ৯ বিধানসভায় প্রায় সমান সমান আসনে জয়ী হত দুই দলই। কিন্তু প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সীর মৃত্যুর পর থেকে কংগ্রেসের অস্তিত্ব ক্রমশ হারাতে শুরু করে। বর্তমানে ওই জেলায় কংগ্রেসের আসন সংখ্যা শূন্য। ২০১১ সালের পর থেকে গোটা জেলাতেই তৃণমূলের জয় হয়। এখানে যে চারটি পুরসভা রয়েছে, সেগুলিও তৃণমূলের দখলে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
উত্তর দিনাজপুর জেলার সদর দফতর, রায়গঞ্জ। এটি ১৯৫১ সাল থেকে একটি পৌর শহর এবং এটি উত্তরবঙ্গের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। স্থানটি জাতীয় মহাসড়ক, রাজ্য মহাসড়ক এবং রেলপথের মাধ্যমে রাজ্যের বাকি অংশের সঙ্গে ভালভাবে সংযুক্ত। জাতীয় সড়ক ৩১ ও জাতীয় সড়ক ৩৪, এই জেলার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। এখানের বড় স্টেশনগুলি হল রায়গঞ্জ, রাধিকাপুর, কালিয়াগঞ্জ, ডালখোলা, আলুয়াবাড়ি রোড জংশন। দূরপাল্লার ট্রেনগুলির ক্ষেত্রে ডালখোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন। রাধিকাপুর-কলকাতা এক্সপ্রেস ট্রেন ও রাধিকাপুর-হাওড়া কুলিক এক্সপ্রেস ট্রেন রায়গঞ্জ থেকে দক্ষিণবঙ্গে সরাসরি আসার দুটি ট্রেন। অন্যদিকে রায়গঞ্জ উত্তরবঙ্গে যাওয়ার একমাত্র সরাসরি ট্রেন রাধিকাপুর-শিলিগুড়ি ডেমু। উত্তরবঙ্গ রাজ্য পরিবহন নিগম ও দক্ষিণবঙ্গ রাজ্য পরিবহন নিগমের পরিষেবা এখানে পাওয়া যায়। উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গকে হাইওয়ে দিয়ে জোড়ে শিলিগুড়ি মোড়।
পর্যটন
দুদিকে বিস্তৃত রাজমহল পাহাড়, আর মাঝে বয়ে চলেছে কুলিক নদী। এই নদীর তীরে রায়গঞ্জ হল জেলা সদর। সেখানেই ১৯৮৫ সালে তৈরি হয় এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম পাখিরালয়, 'রায়গঞ্জ বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ কেন্দ্র'। পাহাড়, জঙ্গল, নদীর মিশ্রণে তৈরি এই অপরূপ সুন্দর জেলা পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। রায়গঞ্জ বণ্যপ্রাণ সংরক্ষণ কেন্দ্র তো রয়েইছে, সেই সঙ্গে পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে, কুনোর গ্রাম, বুরহানা ফকির মসজিদ, রায়গঞ্জ চার্চ, কর্ণজোড়া মিউজিয়াম ও উদ্যান, শ্রী দিগম্বড় আদিনাথ জৈন মন্দির, স্বামীনাথ মন্দির, সাপ নিকলা জঙ্গল, ভোপালপুর মেলা।
অন্যান্য
উত্তর দিনাজপুরের সঙ্গীত হিসাবে খান, নাটুয়া, জং গান জনপ্রিয়। সঙ্গে মোক্ষ ডান্স ও হালনা হালনানি নৃত্যও ভীষণ জনপ্রিয়।
তথ্যসূত্র:
https://uttardinajpur.gov.in/
https://wbnorthbengaldev.gov.in/