কমলকৃষ্ণ দে, পূর্ব বর্ধমান: দীর্ঘদিন ধরেই মা দুর্গার আরাধনা হয় এই বাড়িতে। চকদিঘির এই জমিদার বাড়িতেই পুজোর সময় আসতেন বিদ্যাসাগর। মহাপুরুষের পদধূলিধন্য এই বাড়িতে আজও একইভাবে চলে আসছে দুর্গাপুজো। সিংহরায় পরিবারের এই পুজোয় রয়েছে অবাক করা সব নিয়ম। স্থলপদ্মেই দেবীর পুজোয় হয় এখানে। একমাত্র সন্ধিপুজোর সময়েই লাগে জলপদ্ম। এই জমিদার বাড়িতে পুজো শুরু হয়ে যায় প্রতিপদ থেকেই।
জমিদার বাড়ির সিংহরায় পরিবারের তত্ত্বাবধানেই হয় এই পুজো। মহালয়ার ভোরে পিতৃপক্ষের অবসান ঘটে। শুরু হয় দেবীপক্ষ৷ আর সেই সময় থেকেই সমস্ত ধর্মীয় আচার মেনেই পুজো শুরু হয় চকদিঘির জমিদার বাড়ির পুজোর। বৈদিক মতে হয় সিংহরায় জমিদার বড়ির দুর্গাপুজো। একচালার কাঠামোয় ডাকের সাজে প্রতিমা সাজানো হয়। দেবী মূর্তির দু’পাশে বসানো থাকে জয়া ও বিজয়ার মূর্তি। মন্দিরচত্বর সাজানো হয় ভিন্ন আঙ্গিকে। একটি গোটা নারকেল, আমপল্লব ও একটি কাঁঠালি কলা একসঙ্গে নিয়ে বাঁধা থাকে মন্দিরের প্রতিটি থামে।
নৈবেদ্যে অন্য ফলের সঙ্গে থাকে কাজু-কিসমিস-পেস্তা-আখরোট ও মেওয়া। নৈবেদ্য সাজানো হয় চিনির সন্দেশ, ছোট ও বড় মোণ্ডা, ডোনা, নবাত, রসকড়া, মুড়কি প্রভৃতি দিয়ে। পারিবারিক নিয়ম মেনে স্থলপদ্মে হয় দেবীর পুজো । একমাত্র সন্ধিপুজোয় লাগে ১০৮ টি জল পদ্ম। পুজোর প্রতিটি দিন দেবীর কাছে নিবেদন করা হয় হরেক রকম নিরামিষ ভোগ। মহাষ্টমীর দিন থেকে পুজোর নৈবেদ্যে দেওয়া হয় মাখা সন্দেশ।
সিংহরায় পরিবারের ইতিহাস ঘাঁটলেই জানা যায়, এই পরিবারের পুজোয় অংশ নিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর৷ বহুবার তিনি সিংহরায় পরিবারের পুজোয় উপস্থিত থেকেছেন ৷ জমিদার বাড়ি লাগোয়া একটি পুকুর, তার বাঁধানো ঘাট ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের খুব প্রিয় ছিল। সেই জায়গায় ছিল দুটি ঘরও ছিল। যা আজ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। সেখানে বসে পড়াশোনা লেখালেখির কাজ করতেন বিদ্যাসাগর।
এই পরিবারের মহিলা সদস্যরা আগে দেবীর কাছে পুষ্পাঞ্জলি যখন দিতে আসতেন তখন গ্রামের সাধারণ মানুষ তাঁদের মুখ দেখতে পেতেন না৷ মন্দিরের ভিতরে পর্দা ঘেরা জায়গায় বসে তারা অঞ্জলি দিতেন৷ একমাত্র পুরোহিত মহিলাদের মুখ দেখতে পেতেন। এখনও সেই প্রথাই চলে আসেছে সিংহরায় পরিবারের৷ এই পরিবারের পুজোর সমস্ত আয়োজন আজও সেই পুরানো রীতি মেনেই বাড়ির পুরুষরা করে আসছেন৷ এখনও কোনও মহিলা পুজোর কোনও কাজে অংশ নেন না।
এই বাড়িতে এক সময় সিনেমার শ্যুটিং হয়েছে নিয়মিত। বিশিষ্ট পরিচালক সত্যজিৎ রায় এখানে থেকে তাঁর চলচ্চিত্রের শ্যুটিং করেছেন। সংস্কারের অভাবে বয়সের ছাপ স্পষ্ট তবুও সাবেকিয়ানায় ঐতিহ্যে আজও অনন্য পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের এই চকদিঘি জমিদারবাড়ি। তবে আগেকার পুজোর জৌলুস অনেকাংশেই কমেছে।আগে দুর্গাপুজো উপলক্ষে জমিদার বাড়ি সেজে।উঠতো,ঝার লন্ঠনের পাশাপাশি আলোর রোশনাই ছড়িয়ে পড়ত গোটা জমিদার বাড়িতে।হতো বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পুজো উপলক্ষে জমিদার বাড়িতে গ্রামবাসীদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হত। তবে তা অনেকাংশেই অতীত।