বঙ্গভঙ্গের বয়স এক বছর। ১৯০৬। বাংলায় তখন এক টালমাটাল সময়। স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউ। ইউনিভার্সিটি কমিশন আর ইউনিভার্সিটি অ্যাক্টের তীব্র বিরোধিতা বঙ্গসমাজের একাংশে। তারই মধ্যে উপাচার্য হলেন স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।



দেশী কলেজের সরকারি অনুমোদন বাতিল করেছে ব্রিটিশ সরকার। স্কুল কলেজে নিষিদ্ধ তখন ‘বন্দেমাতরম'গাওয়া। তা নিয়ে ফুটছে বঙ্গ। কিন্তু স্বদেশী ঝড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পরিকাঠামোকে ভেঙে পড়তে দেননি বাংলার নরশার্দূল। বাংলার স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউয়ের দাপটে যখন ব্রিটিশ সরকার প্রায় নাটাঝাপটা খাচ্ছে, তখন তারা চেয়েছিল এমন একজন বাঙালি মনীষীকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথায় বসাতে, যিনি প্রকৃত অর্থেই শিক্ষানুরাগী। সেই জন্যই আশুতোষকে মনোনীত করে ইংরেজ সরকার।

স্বদেশীরা তখন ব্রিটিশ সরকারের গোলাম তৈরির কারখানা বলে তখন কটাক্ষ করতেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে। এই সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নেওয়া মানে তো জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর দিয়ে হাঁটা। কিন্তু আশুতোষ শক্ত হাতে ধরলেন হাল। হয়ে উঠলেন কঠিন সময়ের কাণ্ডারি !অশান্ত বাংলায় প্রবল ব্রিটিশ বিরোধিতার মধ্যেই ধরলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাশ। তিনি কখনওই উচ্চশিক্ষায় রাজনীতির চাপানউতোর চাননি ।  অচিরেই উচ্চশিক্ষা আর গবেষণার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। দেশ-বিদেশের বিদ্যারত্নরা অলঙ্কৃত করেছেন শিক্ষামঞ্চকে। আশুতোষ এই চাওয়াটাই বিভিন্ন সময় ব্যক্ত করেছেন তাঁর কথায়। ১৯০৪ সাল। তখনও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব তিনি নেননি। Imperial Legislative Council Proceedings এ তিনি বলেছিলেন, "We require teachers whose duty it will be not to impart elementary instruction for the purposes of the University examinations... but whose function it will be to extend the bounds of knowledge and to guide their students in their attempt to search out the secrets of nature" অর্থাৎ "আমাদের এমন শিক্ষকদের প্রয়োজন যাদের দায়িত্ব হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার উদ্দেশে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া নয়...যাঁদের কাজ হবে জ্ঞানের সীমানা প্রসারিত করা এবং তাঁদের ছাত্রদের প্রকৃতির মধ্যে গোপনীয়তা অনুসন্ধানের প্রচেষ্টায় পথনির্দেশ করা।"

একটু ভেঙে, একটু গড়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে নতুন কাঠামোয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। নতুন বিভাগ, নতুন গবেষণা, নতুন শিক্ষকদের সমাহারে সেজে উঠল বিশ্ববিদ্যালয়। একদিকে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় থেকে সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণ, অন্যদিকে ফরাসি অধ্যাপক সিলভাঁ লেভি থেকে অক্সফোর্ডের অধ্যাপক পল ভিনোগ্রাডফ। রত্নসমাহার ঘটেছিল আশুতোষের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।  স্বদেশ ও বিদেশের গুণী অধ্যাপকদের  বিশেষ বক্তৃতার আয়োজন করেন তিনি। দীনেশচন্দ্র সেন ‘আশুতোষ স্মৃতিকথা'য় উল্লেখ রয়েছে, সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় আলোকিত করেন ইংরাজী অধ্যাপক স্টিফেন, অঙ্কের অধ্যাপক কালিস, জার্মান পণ্ডিত ব্রুল, পারস্যদেশবাসী সিরাজী, জাপানী ও চিনা পণ্ডিত মাসুদা ও কিমুরা,  প্রভৃতি । এছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শিক্ষাবিদরা।

  একদিকে বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন তিনি, অন্যদিকে খুলে দিয়েছিলেন বিশ্বমানের বিজ্ঞানচর্চার বাতায়ন।  তাঁর আমলেই খোলা হয় বাংলা, সংস্কৃত, পালি ,  তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিভাগ, প্রাচীন, মধ্যযুগীয় এবং আধুনিক ভারতের ইতিহাস বিভাগ। বিভাগসেই জন্যই হয়ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ‘বিদ্যার সারথি' বলেছিলেন। একবার আশুতোষের প্রয়াণ দিবসে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “বাঙালীর চিত্তক্ষেত্রে আশুতোষ, বিদ্যার সারথি,তোমারে আপন নামে সম্মানিত করেছে ভারতী।”

আশুতোষ ১৯০৬ থেকে ১৯১৪ এবং পরবর্তীতে ১৯২১ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। প্রথম পর্যায়ের আট বছরেই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করেন। এই সময় আশুতোষ বিদ্যাঙ্গনকে প্রকৃত অর্থেই শিক্ষার তীর্থক্ষেত্রে উন্নীত করেছিলেন, যা রবীন্দ্র-ভাবনারই অনুরণন - “সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থনীরে, এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।”

তথ্যসূত্র :


আশুতোষ বিদ্যার সারথি 

 ‘আশুতোষ স্মৃতিকথা',  দীনেশচন্দ্র সেন

Education Loan Information:

Calculate Education Loan EMI