কলকাতা: ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পর রাজনীতির ময়দানে সদ্য পা রেখেছেন। আর নেমেই জয়। বিধানসভা নির্বাচনে পূর্ব মেদিনীপুরের ময়না কেন্দ্রে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে ১২৬০ ভোটে হারিয়েছেন বিজেপি প্রার্থী। যে জয়ের পরতে পরতে ছিল নাটক। ম্যাচের ফয়সালা যেন হল সুপার ওভারে! এবিপি লাইভ-কে রুদ্ধশ্বাস সেই রাজনৈতিক টক্করের গল্প শোনালেন অশোক দিন্দা


প্রশ্ন: বাংলার নির্বাচনে বিজেপির প্রত্যাশিত ফল হয়নি। কিন্তু রাজনীতির বাইশ গজে সদ্য নেমেই আপনি সেই দলের স্ট্রাইক বোলার। ময়না কেন্দ্র থেকে জয়। কীরকম অনুভূতি?


অশোক দিন্দা: খুবই ভাল লাগছে। জিতেছি। তবে শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে হয়েছে। গণনাকেন্দ্রেও ভয় দেখানো হয়েছে, হুমকি দেওয়া হয়েছে। গণনার দিন বাইরে থেকে প্রচুর লোক জড়ো হয়েছিল কোলাঘাটের গণনাকেন্দ্রে। বাইরে বেরলে কেটে কুচিয়ে দেবে বলে শাসিয়েছিল। আমি বলেছিলাম, ঠিক আছে। জয়ের সার্টিফিকেটটা নিই। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করি। তারপর না হয় আমাকে মারবেন। বাকিটা দেশের মানুষ বুঝে নেবেন। আমি সার্টিফিকেট না নিয়ে বেরব না। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। যখন জিতলাম, তখন সাড়ে বারোশো ভোটের ব্যবধান। আচমকা রিটার্নিং অফিসার আমাকে বলল, তৃণমূল কংগ্রেস নাকি পুনর্গণনার দাবি জানাচ্ছে। আমি জানতে চেয়েছিলাম, কীসের জন্য? সকালে ২৭৫টি পোস্টাল ব্যালট বাতিল হয়েছিল। কারণ, কেউ পাঁচ-ছজনের নামের পাশে টিক দিয়েছিলেন। কেউ ফাঁকা ব্যালট পাঠিয়েছিলেন। কেউ আবার ভোট দিয়ে নীচে নিজের নাম লিখে দিয়েছিলেন। সকালে নিয়ম মেনেই সেগুলি বাতিল করে সব প্রার্থীদের জানিয়ে দেওয়া হয়। রাতে আচমকা সেগুলো ফের গোনার দাবি করেন তৃণমূল কংগ্রেসের এজেন্টরা। আমি জিতেছি সাড়ে বারোশো ভোটে। যদি ধরেও নিই বাতিল সব ব্য়ালট ভোট তৃণমূল পেয়ে গেল, তাও তো আমি জিতছি। তাও চাপ দেওয়া হয়। শেষে আমি বলি, বাতিল ব্যালট গুনলে তা ভিডিও করে রাখতে হবে। বিতর্ক এড়াতে সব ক্য়ামেরাবন্দি করে রাখুন। বাতিল ব্যালট ফের খুলে দেখা যায়, সঙ্গত কারণে নিয়ম মেনেই সব রিজেক্ট হয়েছিল। একটা ভোটও কারও কাছে যায়নি। তারপরও জয়ের সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যাপারেও গড়িমসি করেছে। বাইরে থেকে তখন টিএমসি সাপোর্টাররা ক্রমাগত চিৎকার করে বলছে, 'তুই বাইরে আয়। কেটে কুচিয়ে দেব। বাইরের থেকে এসেছিস। রাজ্যে আমরাই ক্ষমতায় থাকছি।' কিন্তু আমি সার্টিফিকেট নিয়েই বেরিয়েছি। রাত ১২.১৫ নাগাদ সার্টিফিকেট পেয়েছি। যত রাত হয়েছে, বাইরে তৃণমূলের লোক বেড়েছে। সকলে চেয়েছিল যাতে আমি ভয় পেয়ে পালাই। আমি ময়দান ছাড়িনি। খেলার মাঠ ছেড়ে কখনও পালাইনি। যদি হেরেও যেতাম, শেষ পর্যন্ত থেকে দেখে যেতাম আমি কত ভোটের ব্যবধানে হারলাম।



প্রশ্ন: পুলিশ পদক্ষেপ করেনি?


দিন্দা: পুলিশ সকালের দিকে ভাল দায়িত্ব সামলেছে। তবে দুপুরের পর থেকে তাদের ভূমিকা পাল্টে যায়। আমি অবশ্য ভয় পাইনি। জানতাম অন্যায় করিনি। আমাকে এসডিপিও এসে বলেন, আপনার সঙ্গে এত লোকজন কী করছে? আমি জবাব দিয়েছিলাম, যাঁদের দেখছেন, তাঁরা প্রত্যেকে কাউন্টিং এজেন্ট। সকলের কাছে নির্বাচন কমিশনের পরিচয়পত্র রয়েছে। পাল্টা বলি, তমলুকের রেজাল্ট বেরিয়ে গিয়েছে। তারপরও তমলুকের তৃণমূল এজেন্টরা কী করছেন? আমার সঙ্গে তো দশজন ছিল। ওরা দেড়শোজন মাঠে ঢুকে গিয়েছিল। আমি এসডিপিওকে বলি, পোস্টাল ব্য়ালট পুনর্গণণা হবে। আমাদের থাকতে হবে। তখন আর কিছু বলতে পারেননি। 


প্রশ্ন: রাজ্য জুড়ে বিজেপির প্রবল হাওয়া ছিল। অনেকে ভেবেছিলেন তৃণমূল-বিজেপি হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। কিন্তু ম্য়াচটা কার্যত একপেশেভাবে জিতে নিল তৃণমূল...


দিন্দা: আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, গণনাকেন্দ্রের বাইরে বহু জায়গায় হুমকি দেওয়া হয়েছে। অনেক এজেন্ট পালিয়ে গিয়েছেন। বসতে পারেননি ভয়ে। তৃণমূল আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছিল। বিজেপি ৯২টি আসনে এক হাজারের কম ভোটে হেরেছে। যদি শেষ পর্যন্ত সকলে থাকতে পারতেন, এই ৯২ আসনের ৬০-৭০ শতাংশে আমরাই জিততাম।


প্রশ্ন: বিধায়ক হিসাবে নতুন ইনিংস। দায়িত্ব কতটা বাড়ল?


দিন্দা: প্রচুর দায়িত্ব বেড়েছে। মানুষকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তা কতটা পূরণ করতে পারব জানি না। তবে অন্তর থেকে চেষ্টা করব। মানুষের পাশে সব সময় ছিলাম। আছি। থাকব।


প্রশ্ন: জয়ের পর বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে কোনও বার্তা?


দিন্দা: অনেকের সঙ্গেই কথা হয়েছে। শীর্ষ নেতৃত্বের সকলেই বাহবা দিয়েছেন। বলেছেন, গণনার শেষ পর্যন্ত না থাকলে হয়তো জিততে পারতে না। গোটা দেশ থেকে শুভেচ্ছাবার্তা এসেছে।



প্রশ্ন: ক্রিকেটারদের কেউ শুভেচ্ছা জানিয়েছেন?


দিন্দা: প্রচুর ক্রিকেটার শুভেচ্ছা জানিয়েছে। মুম্বই, চেন্নাই-সহ বাইরের অনেক ক্রিকেটারও বার্তা পাঠিয়েছে। কারও নাম বলতে চাই না।



প্রশ্ন: বিধায়ক হিসাবে ময়নার জন্য স্ট্র্যাটেজি কী?


দিন্দা: প্রথমেই দলমত নির্বিশেষে সকলকে এক হয়ে করোনাকে হারাতে হবে। সেটাই প্রাধান্য। ময়না বিধানসভা কেন্দ্রে তিনটি গ্রামীণ হাসপাতাল আছে। সেগুলোর পরিকাঠামোর উন্নতি করতে হবে। মেরামত করতে হবে। চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নয়ন আমার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে গ্রামেই যাতে তার চিকিৎসা করানো যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ময়নার মানুষ যাতে ওখানেই চিকিৎসা করাতে পারেন, কলকাতায় দৌড়ে আসতে না হয়।


প্রশ্ন: বিধানসভায় যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে?


দিন্দা: যেদিন রাজনীতিতে এসেছিলাম, সেদিন থেকেই মানসিক প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। মানসিকভাবে তৈরিই ছিলাম। ময়নার মানুষ ভালবেসেছেন। আশীর্বাদ করেছেন। তাদের হয়ে লড়াই করতে আমি প্রস্তুত।


প্রশ্ন: বিধায়কের ব্য়স্ততা শুরু হয়ে গিয়েছে?


দিন্দা: ফল ঘোষণার পর থেকে রাতের ঘুম চলে গিয়েছে। দিকে দিকে আমাদের দলের কর্মী-সমর্থকেরা মার খাচ্ছেন। বাড়ি, পার্টি অফিস ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। আমি সব দলের সকলের কাছে আপনাদের মাধ্যমে আবেদন করব, ঐক্যবদ্ধ থাকুন। এটা স্বাধীন ভারত, স্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ। ভোটে এক দল জিতেছে, এক দল হেরেছে। সেটাই নিয়ম। ক্রিকেট মাঠের মতোই। দুটো দলই তো আর একসঙ্গে জিততে পারে না। তা বলে যারা হেরে গিয়েছে তাদের ধরে ধরে মারবে, ঘরবাড়ি ভেঙে দেবে, প্রাণে মেরে ফেলা হবে!


প্রশ্ন: ময়নায় কি ভোট পরবর্তী হিংসার খবর পাচ্ছেন?


দিন্দা: প্রচুর। আমি জিতেছি, অথচ আমাদের দলের লোকেদের ভয় দেখানো হচ্ছে, মারছে। কারণ তৃণমূল কংগ্রেস সরকার গড়েছে। কারও প্রাণ যাওয়ার চেয়ে বড় কিছু হতে পারে না। খুনোখুনি বন্ধ করুন। আমার কাছে খবর এসেছে, লোককে জলে ডুবিয়ে পর্যন্ত মারধর চলছে। খারাপ লাগছে এসব দেখে।


প্রশ্ন: ভোটের ময়দানে নেমেই জয়। লেডি লাক?


দিন্দা: (হাসি) স্ত্রী শ্রেয়সী সব সময় পাশে থাকে। মেয়ে টিয়ারা কথা বলতে শিখছে। ওর মা ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, পাপা জিতবে তো? বলেছিল জিতবে। আমি ভিকট্রি সাইন দেখাতে বলেছিলাম। দেখিয়েছিল। সকলের শুভেচ্ছা, ভালবাসা পেয়েছি।



প্রশ্ন: ময়নায় যাতায়াত বেড়ে গেল তা হলে?


দিন্দা: ময়নাও আমার পরিবার। সব দলের লোকই আমার আপন। সে বিজেপি হোক বা তৃণমূল, সিপিএম, কংগ্রেস। সকলের কাজে আসার চেষ্টা করব। সব দলের সমর্থকদের জন্যই কাজ করতে চাই। মানুষের বিপদ আপদে সব সময় রয়েছি। ময়নার নৈছনপুরে আমার বাড়ি। সেখানে থাকব মাঝেমধ্যেই।