উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়, জলপাইগুড়ি: পাহাড় সুন্দরীকে ঢেলে সাজানোর কথা শোনা গিয়েছে বার বার। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে যায়। এবারেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনের (Panchayat Elections 2023) আগে চা বাগানগুলি কার্যতই ঢেকে গিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পতাকায়। কিন্তু ভোটের ঝুলি ভরার প্রচেষ্টার মাঝেই শোনা যাচ্ছে দীর্ঘশ্বাস। চা বাগানের ধাপে ধাপে শুধুই না পাওয়ার গল্প (Alipurduar News)।
শহরের কোলাহল থেকে দূরে, পাহাড়ের ঢালে সবুজে মোড়া চা বাগান। মেঘের দল যেন ছুঁয়ে যায় চূড়া। অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়া চারিদিক। তাই ফুরসত পেলেই দলে দলে ছুটে যান মানুষজন। নির্বাচনী মরশুমে পাহাড়বাসীর মনজয়ে মরিয়া রাজনীতিকরাও। কিন্তু পাহাড়ের ঢালে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে চা শ্রমিকদের একরাশ 'না পাওয়া' আর বাস্তবের সঙ্গে কঠিন লড়াইয়ের কথা।
এই 'না পাওয়া'র আক্ষেপ যদিও নতুন নয় একেবারেই। নির্বাচনের আগে সেই 'না পাওয়া'কে পাওয়ায় বদলে দিতে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেন শাসক থেকে বিরোধী, সকলেই। শুরু হয় কৃতিত্ব নেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু নির্বাচনের আগে বন্যার জলের মতো প্রতিশ্রুতি এলেও, তা শেষ হতেই বদলে যায় পরিস্থিতি। কর্পূরের মতো উবে যায় সমস্ত প্রতিশ্রুতি, অঙ্গীকার, পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস।
তাই মাদারিহাটের জয়শ্রী চা বাগানের বাসিন্দা সুষমা মুর্মু বলেন, "ভোটের আগে সবাই বলে এটা দেব ওটা দেব, ভোট চলে গেলে কারও দেখা পাই না। কী হবে আমাদের?"
আরও পড়ুন: Panchayat Election: 'সমান্তরাল সরকার পরিচালনার চেষ্টা', রাজ্যপালের বিরুদ্ধে কমিশনকে চিঠি দিল TMC
এবছর পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে সেখানে প্রচারে গিয়েছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, "এলাকার প্রায় সব চা বাগান খুলে দিয়েছি। বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল চা বাগান খোলার। ওরা করেনি, তৃণমূল করেছে। শ্রমিকদের জন্য ঘর বানিয়ে দেব। চা-বাগানের পাট্টা দেব, কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে।"
এর আগে, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে পাহাড়বাসীকে আশার বাণী শুনিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। তাঁকে বলতে শোনা যায়, "চা শ্রমিকদের বলছি, বাংলার বিজেপি সরকার আপনাদের জন্য দিনরাত কাজ করবে। দিদি আপনাদের জন্য কিছু করেনি। অসমে বিজেপি-র ডাবল ইঞ্জিন সরকার, চা শ্রমিকদের বর্ধিত মজুরি, জমির পাট্টা, পর্চা দিয়েছি। বাংলাতেও হবে।"
পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে পাহাড়েও জোরকদমে প্রচার চলছে, সেই সময় এবিপি আনন্দ আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাটের জয়শ্রী চা বাগানে পৌঁছে গিয়েছিল। সেখানেই ক্যামেরার সামনে আক্ষেপ ঝরে পড়ে সুষমা মুর্মুর গলায়। বয়সের ভারে অশক্ত শরীর। বাগানের কাজ থেকে ছুটি মিলেছে ওই বৃদ্ধার। কিন্তু কোথায় যাবেন? তাই বাগানের মধ্যেই ভাঙা ঘরে বাস। তাঁর ছেলে মোহন মুর্মু বলেন, "বাড়িঘর দেখতেই পাচ্ছেন। যেদিন কাজে যেতে পারি না, একটাকাও পাই না।" বন্ধ চা বাগানের শ্রমিক ললিত মুর্মু বলেন, "বাগান বন্ধ হয়ে গেল। কিছু টাকা তো পেলামই না, উল্টে যা কোম্পানির ঘরে জমিয়েছিলাম, সেটাও নিয়ে চলে গেল।"
এই অন্ধকারের মধ্যেই সেখানে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে রাখতে চান রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তনী। বাংলায় স্নাতকোত্তর এই যুবক সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছেন, ডাক আসেনি। তাই বাগানের শিশুদের অক্ষর চেনানোর দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন তিনি। কিন্তু সরকার এবং প্রশাসন উদ্যোগী না হলে, ব্যক্তি বিশেষের দ্বারা কতটাই বা সম্ভব? পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে উঠে আসছে এই প্রশ্নউ। আরও একটি নির্বাচন এগিয়ে আসছে। আশ্বাসে কমতি নেই এবাারও। কিন্তু চা বাগানের ছবি কি পাল্টাবে আদৌ? সংশয়ে শ্রমিকরা।