কলকাতা: আশ্বাস ছিল অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোটের। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার কতটা ঘটল? শনিবার, পঞ্চায়েত ভোট (Panchayat Election 2023) ঘিরে রাজ্যের নানা প্রান্তে দেদার ছাপ্পা ভোট, ব্যালট বাক্স নষ্ট ও চুরি, হিংসা, বোমাবাজি ও গুলিচালনা এবং প্রাণহানির যে একের পর এক অভিযোগ উঠেছে, তাতে কাঠগড়ায় রাজ্য নির্বাচন কমিশন (State Election Commission)। এমন ভয়ের আবহে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট সম্ভব কি? এই নিয়ে শাসক-বিরোধী তরজা নতুন মাত্রা পায় শনিবার। তৃণমূলের তরফে অবশ্য় বার বার দাবি করা হয়, গোটা রাজ্যে যত বুথ রয়েছে তার নিরিখে হাতেগোনা কয়েকটিতেই এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। বেশিরভাগ ঘটনাতেই শাসকদলের নিশানায় বিরোধীরা। অন্য দিকে, বিরোধীরা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় অত্যন্ত অসন্তুষ্ট। রাতের দিকে, প্রতিবাদ জানিয়ে কমিশনে প্রতীকী তালা ঝুলিয়ে দিতে দেখা যায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে। তীব্র টানাপড়েনে বাংলা যখন উত্তাল, তখন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহার বক্তব্য, 'পুলিশ আশা করি ব্যবস্থা নেবে।' কিন্তু কবে? শুধুমাত্র ভোটের দিনেই যে ১৬টি প্রাণ চলে গেল, তাঁদের পরিবার কবে ন্যায়বিচার পাবে? উত্তর নেই। শুধু মনে থেকে যাবে এই দিনের ঘটনা...


একনজরে পঞ্চায়েত ভোট...

খুন কদম্বগাছিতে...   
শনিবার ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই খবর। উত্তর ২৪ পরগনার কদম্বগাছিতে নির্দল প্রার্থীর সমর্থককে খুন করা হয়েছে। অভিযোগের নিশানায় শাসকদলের কর্মীরা। তৃণমূলের বিরুদ্ধে বোমা-বন্দুক নিয়ে হামলার অভিযোগ ওঠে। সেই শুরু। তার পর, একের পর এক, প্রাণহানির খবর।


পর পর প্রাণহানি...
হিসেব বলছে, স্রেফ ভোটের দিনেই বিভিন্ন জেলায় খুন হয়েছেন ১৬ জন! সাধারণ ভোটার থেকে রাজনৈতিক দলের কর্মী - কাউকে ছাড়ল না সন্ত্রাস! এই ১৬ জনের মধ্যে ৫ জনই মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা। গত রাত থেকে এদিন পর্যন্ত এই ৫ জনের প্রাণ গিয়েছে। এদিন সকালের দিকে কদম্বগাছির ঘটনার পর পরই খবর আসে, মুর্শিদাবাদের খড়গ্রামে ফের খুন হয়েছে।  কংগ্রেস কর্মী খুনে অভিযুক্তর দেহ উদ্ধার হয় এদিন। ধাতস্থ হয়ে ওঠার আগেই রাজ্যবাসী জানতে পারেন মালদার মানিকচকে বোমার আঘাতে প্রাণ গিয়েছে এক তৃণমূল কর্মীর। কংগ্রেসের সঙ্গে সংঘর্ষে বোমাবাজি শুরু হয় এদিন সকালে, তাতেই প্রাণ হারান তিনি। রক্তাক্ত হয়েছে কোচবিহারও। সেখানে মারা যান বিজেপির পোলিং এজেন্ট মাধব বিশ্বাস। শাসকদলের বিরুদ্ধে গুলি করে খুনের অভিযোগ ওঠে। দুপুরের দিকে মুর্শিদাবাদের নওদা থেকে ফের রক্তপাতের খবর আসে। নিহত কংগ্রেস কর্মীকে গুলি করে খুন করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। আবার উত্তর দিনাজপুরের চাকুলিয়ায় মারা যান এক তৃণমূলকর্মী। বস্তুত, শুক্রবার রাত থেকে এখনও পর্যন্ত যে ১৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে, তাঁদের মধ্যে ১০ জনই তৃণমূল কর্মী। বাকিদের মধ্যে ২ জন সিপিএমের, ২ জন কংগ্রেসের, ২ জন বিজেপির এবং ১ জন সাধারণ ভোটার বলে জানা যায়। মুর্শিদাবাদ ছাড়াও মালদা, উত্তর দিনাজপুর, কোচবিহার, নদিয়া, পূর্ব বর্ধমান, রক্তের ছিটে লেগেছে জেলায় জেলায়।  


ভোট লুঠ...
হিংসা ও রক্তপাত যদি ভোটের দিনের একটা ছবি হয়, তবে অন্য দিকে রয়েছেন দেদার অনিয়মের ঘটনা। সকালের দিকে যেমন কোচবিহারের দিনহাটার একটি বুথে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। আবার উত্তর ২৪ পরগনার জ্যাংড়ায় বুথদখলের অভিযোগ আসে। জ্যাংড়ায় ব্যালট বাক্স জঙ্গলে ফেলে দেওয়ার অভিযোগও শোনা যায়। ভোটের শুরু থেকেই দফায় দফায় উত্তেজনা দেখা দেয় মুর্শিদাবাদের রানিনগরে। সেখানে সিপিএমের বিরুদ্ধে তৃণমূলকর্মীর মাথা ফাটানোর অভিযোগ ওঠে, পাল্টা লাঠি নিয়ে আক্রমণ শানায় শাসকদলও। পরে অবাধে বোমাবাজির খবরও শোনা যায়। এদিন দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তী, ভাঙড় থেকে মুর্শিদাবাদ, মালদা, হয়ে কোচবিহার, জলপাইগুড়ি-- দিকে দিকে ভোট লুঠ, ব্যালট বাক্স নষ্ট ও চুরির অভিযোগ শোনা যায়। কিন্তু কেন্দ্রীয় বাহিনী কোথায়? প্রশ্ন সাধারণ মানুষ থেকে বিরোধী শিবিরের। কোথাও কোথাও পুলিশের দেখা মিললেও তাঁদের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। কোথাও আবার আক্রান্ত পুলিশ নিজেই। প্রিসাইডিং অফিসার থেকে ভোটার, চোখে জল দেখা গিয়েছে কারও কারও।


কড়া বার্তা রাজ্যপালের...
রাজ্য়ের অবস্থা সরেজমিন খতিয়ে দেখতে বেরিয়েছিলেন রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। ব্যারাকপুর থেকে পৌঁছে গিয়েছিলেন বারাসাতে। কথা বলেছিলেন আক্রান্তদের সঙ্গে। গণতন্ত্রের উৎসবে খুনের ঘটনায় সরব হয়েছেন রাজ্যপাল। পরে বলেন,' শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আশা করেছিলাম। কিন্তু চতুর্দিকে খুন হচ্ছে। মানুষ জানিয়েছে গুন্ডারা ভোট দিতে যেতে বাধা দিচ্ছে। প্রিসাডিং অফিসারও কোনও কোনও সময় সহায়তা করছেন না। এটা বন্ধ হওয়া দরকার। ভোট ব্যালটে হওয়া উচিত, বুলেটে নয়। সকলকে বলব গণতন্ত্রের নিয়ম মেনেই ভোট দিন।' কিন্তু যাঁর তত্ত্বাবধানে সবটা হওয়ার কথা, সেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনার দীর্ঘক্ষণ মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন। পরে মুখ খোলেন।


রাজ্য নির্বাচন কমিশনার যা বললেন...
কেন্দ্রীয় বাহিনী নামানোর পরও আটকানো গেল না প্রাণহানি। শনিবার ভোটগ্রহণের দিনই বেলা আড়াইটে পর্যন্ত ১২ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। সেই আবহে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় আবারও প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। তীব্র সমালোচনার মুখে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিন্হা মেনে নিলেন, এই পঞ্চায়েত নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ বলা সম্ভব নয়। কিন্তু সঙ্গে বললেন, 'অপরাধ ঘটলে প্রথমে মামলা দায়ের হয়। তার পর তদন্ত এবং গ্রেফতারি। আশাকরি পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।'


তীব্র প্রতিবাদ বিরোধী দলনেতার...
ভোটে বেলাগাম সন্ত্রাসের জেরে আগেই 'কালীঘাট চলো' অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। পরে কমিশনারকে ফোন করে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এতেই শেষ নয়। রাতের দিকে কমিশনে প্রতীকে তালাও ঝোলান তিনি। রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সুকান্ত মজুমদারকে ফোন করেছিলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা। সুকান্ত জানালেন, বিশদ রিপোর্ট দেওয়া হবে। দিনভর বিরোধী শিবিরের তীব্র সমালোচনার মুখে শাসকদলের বক্তব্য একটাই, যা ঘটেছে তা সার্বিক নিরিখে সামান্য। কিন্তু একটাও মৃত্যু কি অভিপ্রেত? হাইকোর্টের বার বার সতর্কবার্তা সত্ত্বেও কেন এড়ানো গেল না এত রক্তপাত, অনিয়ম? 


আরও পড়ুন:লাশের সারি বাংলায় ! ৬০ নয় মাত্র ১৫ হাজার বুথে হাজির ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনী, জানালেন রাজীব সিনহা