নয়াদিল্লি: সকাল পর্যন্ত ভিড় ছিল দলীয় কার্যালয়ে। পতাকা, পোস্টার, আবির, বেলুন, নিয়ে তৈরি ছিলেন কর্মী সমর্থকেরা। পেল্লাই ঘড়িতে চলছিল কাউন্টডাউন। কিন্তু বেলা গড়াতেই চারিদিক জনমানুষের চিহ্ণ দেখা গেল না। বৃহস্পতিবার গুজরাতে বিজেপি-র (BJP) প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত হওয়ার পর এমনই দৃশ্য চোখে পড়ল সেখানকার কার্যালয়গুলিতে। অথচ একদিন আগে পর্যন্ত জয় নিয়ে আত্মবিশ্বাসী স্বর শোনা গিয়েছিল দলের নেতাদের। আজ দেখা মিলল না কারও। আর গুজরাতে মুখ থুবড়ে পড়ার দিনই হিমাচল প্রদেশে (Himachal Pradesh Assembly Election 2022) ফের ঘুরে দাঁড়াল কংগ্রেস (Congress)। সেখানে সরকার গড়ার পথে তারা।


২০১৭-য় যেখানে সমানে সমানে লড়াই হয়েছিল, এ দিন গণনা শুরু হওয়াহ কিছু ক্ষণের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বিজেপি-র সামনে প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি কংগ্রেস।  পাঁচ বছর আগে ১৮২ আসনের গুজরাত বিধানসভায় (Gujarat Assembly Election 2022) সকলকে চমকে দিয়ে  ৭৭টি আসন জিতেছিল কংগ্রেস। বিজেপি পেয়েছিল ৯৯টি আসন। এ বারে তার চেয়ে ভাল ফল প্রত্যাশিত ছিল কংগ্রেসের কাছ থেকে। কিন্তু বৃহস্পতিবার গুজরাতে সর্বকালীন খারাপ ফল করল কংগ্রেস।


দুপুর ১টা পর্যন্ত পাওয়া গণনার হিসেব অনুযায়ী, গুজরাতে ১৫৪টি আসনে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। জয় ঘোষণা হলে এই প্রথম গুজরাতে এত সংখ্যক আসন পেল বিজেপি। এত দিন তাদের সর্বাধিক আসন সংখ্যা ছিল ১২৭, যা ২০০২ সালের দাঙ্গার পর জিতিয়ে আনে নরেন্দ্র মোদিকে। এ দিন নয়া রেকর্ড গড়তে চলেছে বিজেপি, কারণ ১৯৮৫ সালে গুজরাতে কংগ্রেসের তৎকালীন মুখ্য়মন্ত্রী মাধবসিংহ সোলাঙ্কির দখলেই সর্বাধিক ১৪৯ আসন পেয়ে সরকার গঠনের নজির ছিল।


আরও পড়ুন: Gujarat Election Result: এখনও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সেতু বিপর্যয়ের বিভীষিকা, মোরবিতে এগিয়ে বিজেপি প্রার্থীই


অন্য দিকে, এ দিন কংগ্রেস শুধু পরাজিতই হয়নি, গুজরাতে সর্বকালীন খারাপ ফল করেছে তারা। দুপুর ১টায় মাত্র ২০ আসনে এগিয়ে ছিল তারা। তাদের শরিক ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি একটিও আসন জিততে পারেনি। বরং প্রথম বার পদার্পণ করেই ৫টি আসন জিতে নিয়েছে আপ। কংগ্রেসের ভোটে ভাগ বসানোই আপের লক্ষ্য বলে এ যাবৎ একাধিক তত্ত্ব সামনে এসেছে। তবে এ বার বিজেপি-র ভোট একলাফে অনেক বেড়ে গিয়েছে। বরং যতটা প্রত্যাশা করা হচ্ছিল, তত ভাল ফল করেনি আপ।


তবে গুজরাতে মুখ থুবড়ে পড়লেও, হিমাচলে ফের ঘরে দাঁড়াল কংগ্রেস। সেখানে ৪০টি আসনে এগিয়ে রয়েছে তারা। বিজেপি এগিয়ে ২৬টি আসনে। আপ একটিও আসনে এগিয়ে নেই। বরং তিন নির্দল প্রার্থী তিন আসনে এগিয়ে রয়েছেন। একই দিনে এমন ভিন্ন পরিণতির নানা ব্যাখ্যা উঠে এলেও, ব্যর্থতার জন্য কংগ্রেস নিজেই দায়ী বলে মত রাজনৈতিক মহলের একাংশের। তাঁদের মতে কংগ্রেসের ভোটের একটি বড় অংশ বিজেপি-তে চলে গিয়েছে। আপও কেটে নিয়েছে কিছুটা। তার জন্য দায়ী খোদ কংগ্রেসই।


রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে গুজরাতে কার্যত একক বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে আসছে কংগ্রেস। সেখানে নব্য দল আপ-কে জায়গা ছেড়ে দেওয়ার মারাত্মক ভুল এবং গাফিলতিটিই করে ফেলেছে কংগ্রেস। কারণ গুজরাতে নির্বাচনী প্রচার নিয়ে দলীয় নেতৃত্বের মধ্যে তেমন গরজই চোখে পড়েনি। ২০১৭ সালে কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার সন্ধি ক্ষণে ছিসেব রাহুল গান্ধী। গুজরাতে দলের তারকা প্রচারক ছিলেন তিনি। ব্যক্তিগত ভাবেও জান লড়িয়ে দেওয়ার মানসিকতা চোখে পড়েছিল। কিন্তু এ বার প্রচারের দায়িত্ব নিতেই গরজ দেখাননি কেউ।


২০১৭ সালে দুই অভিজ্ঞ রাজনীতিক, অশোক গহলৌত এবং আহমেদ পটেলকে পাশে পেয়েছিলেন রাহুল। দলের অভ্যন্তরীণ কলহ বাইরের লোককে আঁচ পেতে দেননি তাঁরা। বরং কৌশলী পথ ধরে এগিয়েছিল প্রচার। কিন্তু কংগ্রেসের নেতৃত্ব থেকে পরিবার সমেত সরে দাঁড়ানোর পর রাহুল ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ নিয়েই ব্যস্ত থেকেছেন। নামে মুখ দেখিয়েছেন প্রচারে, ফলে ২০১৭-র সেই উদ্যম তাঁর মধ্যে দেখতে পাননি মানুষ। গহলৌতকে এ বারও গুজরাতের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রাজস্থানে সচিন পায়লটের সঙ্গে দ্বন্দ্ব নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন তিনি। ফলে গুজরাতকে সময়ই দিতে পারেননি।


সেই তুলনায় হিমাচলে পালা করে সরকার বদলের ইতিহাস স্মরণ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরা। উত্তরপ্রদেশে ব্যর্থতার পর দলকে জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে মরিয়া ছিলেন প্রিয়ঙ্কা। তাই বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই ছত্তীসগড়ের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেলের সঙ্গে মিলে হিমাচলে দলের প্রচারের খুঁটিনাটির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নেন প্রিয়ঙ্কা। একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে সমস্যাগুলি ঝাড়াই-বাছাই করে নেন তাঁরা। পুরনো পেনশন প্রকল্প, বেকারত্ব, অগ্নিবীর প্রকল্পের বিরুদ্ধে জনরোষ, মূল্যবৃদ্ধিকে ঘিরে তৈরি হওয়া হতাশা, চিহ্নিত করে ফেলেন তাঁরা। রাজ্যে ঘুরে ঘুরে একাধিক সভা করেন প্রিয়ঙ্কা। বাঘেলও দীর্ঘ সময় ঘাঁটি গাড়েন সেখানে। ১ লক্ষ কর্মসংস্থান, পুরনো পেনশন প্রকল্প ফিরিয়ে আনা, মহিলাদের ১৫০০ টাকা করে ভাতার প্রতিশ্রুতি দেন নির্বাচনী ইস্তেহারে। সেখানেও দলের অন্দরে দ্বন্দ্ব রয়েছে। কিন্তু প্রিয়ঙ্কা স্পষ্টতই জানিয়ে দেন যে, নির্বাচনী প্রচারে সে সব জনসমক্ষ আসা চলবে না। তাতেই হিমাচলবাসীর মনে কংগ্রেসের প্রতি প্রিয়ঙ্কা আস্থা গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। তারই ফলশ্রুতি এই ফলাফল বলে মনে করছেন রাজনৈতি বিশেষজ্ঞরা।