বালুরঘাট: কথিত আছে, পবিত্র আত্রেয়ী নদীর তীরকে পাপ পরিত্যাগের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন পরশুরাম। তাই পৌরাণিক গুরুত্ব রয়েছে। আবার মৌর্য, গুপ্ত, পাল বংশ পেরিয়ে আফগান শাসকের পা-ও পড়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। তাই ঐতিহাসিক গুরুত্বও কম নয় দক্ষিণ দিনাজপুরের জেলা সদর বালুরঘাটের। স্বাধীনতার পর গত ৭৭ বছরে বাংলা এবং বাঙালির জীবনে রাজনৈতিক ভাবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বালুরঘাট। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রের হাল-হকিকত জেনে নেওয়া যাক।  (Balurghat Lok Sabha Constituency)

বাংলার ৪২ টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে অন্যতম বালুরঘাট। একসময় সংরক্ষিত আসন ছিল বটে, তবে এখন অসংরক্ষিত আসন। গোটা দক্ষিণ দিনাজপুর  এবং উত্তর দিনাজপুরের কিছু জেলা বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রে সাক্ষরতার হার ৬১২.৫ শতাংশ। বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রে তফসিলি জাতির ভোটার রয়েছেন প্রায় ৪ লক্ষ ৮ হাজার ৯১৮, ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, যা ২৮.৬ শতাংশ। তফসিলি উপজাতি ভোটার রয়েছেন ২ লক্ষ ১৮ হাজার ৭৫৭, যা ১৫.৩ শতাংশ ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী।  (Lok Sabha Elections 2024)

বালুরঘাটে সংখ্যালঘু মুসলিম ভোটারের সংখ্যা  ৪ লক্ষ ২২ হাজার ৫৭। সবমলিয়ে গ্রামীণ ভোটারের সংখ্যা ১২ লক্ষ ৭৬ হাজার ৭৯৬। শহুরে ভোটারের সংখ্যা ১ লক্ষ ৫২ হাজার ৯৮৭। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় যে পরিসংখ্যান সামনে আসে, সেই অনুযায়ী, বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রের মোট ভোটার ১৪ লক্ষ ২৯ হাজার ৭৮৩। মোট বুথের সংখ্যা ১৫৩০। ২০১৯ সালে মোট ভোটারের ৮৩.৫ শতাংশ ভোটদান করেন। 

বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রের আওতায় যে যে বিধানসভা পড়ে-

বিধানসভা কেন্দ্র জেলা
ইটাহার উত্তর দিনাজপুর
কুশমণ্ডি (SC) দক্ষিণ দিনাজপুর
কুমারগঞ্জ দক্ষিণ দিনাজপুর
বালুরঘাট দক্ষিণ দিনাজপুর
তপন (ST) দক্ষিণ দিনাজপুর
গঙ্গারামপুর (SC) দক্ষিণ দিনাজপুর
হরিরামপুর দক্ষিণ দিনাজপুর

জাতিভিত্তিক সমীকরণ-

জাতি জনসংখ্যা (%?)
বৌদ্ধ ০.০১ %
খ্রিস্টান ১.৩৫ %
জৈন ০.০৩%
মুসলিম ২৯.৫ %
তফসিলি জাতি ২৮.৬ %
তফসিলি উপজাতি ১৫.৩ %
শিখ ০.০২ %

২০২১ সালে বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রের অধীনস্থ বিধানসভাগুলিতে যাঁরা জয়ী হন-

বিধানসভা কেন্দ্র বিধায়কের নাম বিজয়ী রাজনৈতিক দল
ইটাহার মোশারফ হুসেন তৃণমূল
কুশমণ্ডি (SC) রেখা রায় তৃণমূল
কুমারগঞ্জ তোরাফ হোসেন মণ্ডল তৃণমূল
বালুরঘাট অশোক কুমার লাহিড়ি বিজেপি
তপন (ST) বুধরাই টুডু বিজেপি
গঙ্গারামপুর (SC) সত্যেন্দ্রনাথ রাই বিজেপি
হরিরামপুর বিপ্লব মিত্র তৃণমূল

বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রে গত কয়েক বছরে রাজনৈতিক দলগুলির প্রাপ্ত ভোটের হার-

নির্বাচনের বছর তৃণমূল বিজেপি কংগ্রেস সিপিআই সিপিএম RSP AIFB SUCI (C) GOJAM
২০২১ বিধানসভা ৪৮.৭ % ৪১.৭ % ১.৪ % ০.৪ % ২ % ৩.২ %
২০১৯ লোকসভা ৪২.৮ % ৪৫.৫ % ৩.১ % ৬.২ %
২০১৬ বিধানসভা ৪২.৮ % ১০.৮ % ৭.১ % ৬.১ % ১১. ৬ % ১৭. ৪ %
২০১৪ লোকসভা ৩৮.৫ % ২১ % ৭.৬ % ২৮. ৫ %
২০১১ বিধানসভা ৪১.২ % ৩.৯ % ৬.৫ % ৫.৭ % ১৮.৯ % ১৭.৭ %
২০০৯ লোকসভা ৪৩.৮ % ৬.৮ % ৪৪. ৩ %

শেষ তিন লোকসভা নির্বাচনের জয়ী সাংসদ-

২০১৯ সুকান্ত মজুমদার BJP
২০১৪ অর্পিতা ঘোষ TMC 
২০০৯ প্রশান্তকুমার মজুমদার RSP

বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রের নির্বাচনী ইতিহাস বলছে, ১৯৫২ সাল থেকে পর পর বেশ কয়েক বার হাতবদল হলেও, রেভলিউশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টিই সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ই বালুরঘাটে আধিপত্য চালিয়েছে। ১৯৫২ এবং ১৯৫৭ সালে বালুরঘাট থেকে বিজয়ী হন কংগ্রেস প্রার্থী। ১৯৬২ সালে CPI, ১৯৬৭ সালে ফের কংগ্রেসের হাতে ওঠে বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্র। ১৯৭৭, ১৯৮০, ১৯৮৪, ১৯৮৯, ১৯৯১, ১৯৯৬, ১৯৯৮, ১৯৯৯, ২০০৪ এবং ২০০৯ সালে পর পর, লাগাতার বালুরঘাট কেন্দ্রে ক্ষমতা ধরে রেখেছিল রেভল্যুশনারি সোশ্যাল পার্টি (RSP)। ২০১৪ সালে বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রে জয়ী হন তৃণমূলের অর্পিতা ঘোষ। ২০১৯ সালে সেখান থেকে জয়ী হন সুকান্ত মজুমদার। এবারেও বালুরঘাট থেকেই তাঁকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। তৃণমূল প্রার্থী করেছে বিপ্লব মিত্রকে। RSP-র প্রার্থী জয়দেব সিদ্ধান্ত। 

২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দলকে ৩৭০ আসনের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এর মধ্যে বাংলার ৪২টি আসনের মধ্যে অমিত শাহ ৩৫টি আসনে জয়ের লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছেন। মোদি আবার ৪২-এ ৪২-এর ডাক দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে বালুরঘাট ধরে রাখতে মরিয়া বিজেপি। যে কারণে দলের রাজ্য সভাপতি, বালুরঘাটের ভূমিপুত্র সুকান্তকেই পুরনো কেন্দ্রে আবারও প্রার্থী করা হয়েছে। কিন্তু কর্মসংস্থান থেকে পানীয় জল, ফি বছর বন্যা নিয়ে মানুষের মনে ক্ষোভ রয়েছে। পরিষেবা অনেক দেরিতে পৌঁছেছে বলেও অভিযোগ। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সাহায্য়ে নতুন করে জনসংযোগে জোর দিচ্ছেন সুকান্ত। কার্যত বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার সারছেন তিনি। অন্য দিকে, স্বল্পদিন বিজেপি-তে থেকে আবারও ফিরে আসা বিপ্লবকে টিকিট দিয়েছে তৃণমূলে। একসময় সেখানে জোড়াফুল শিবিরের দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। প্রবীণ নেতার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার উপর ভরসা রাখছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু বিভিন্ন সূত্র বলছে, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তৃণমূলের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।

তথ্যসূত্র: Chanakyya