কলকাতা:  ‘দাদা আমি সাতে পাঁচে থাকি না’। মুখে এই কথা বললেও তাঁর যাতায়াত কিন্তু সর্বত্র। রাজনীতির মঞ্চ থেকে শুরু করে অভিনয়, সব জায়গাতেই স্বমহিমায় উপস্থিত রুদ্রনীল ঘোষ। তবে অভিনয় নয়, সম্প্রতি তাঁর শিরোনামে থাকার মূল কারণ রাজনীতি। এককালে তৃণমূলের কট্টর সমর্থকের মুখে আপাতত শোনা যাচ্ছে ‘জয় শ্রী রাম’। তাঁর বিজেপিতে যোগদানের পর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় মিমের ছড়াছড়ি, কটাক্ষের বন্যা।  রুদ্রনীলের বক্তব্য নিয়ে মুখ খুলেছেন তাঁর সতীর্থরাও। কেমন করে সবটা সামলাচ্ছেন তিনি?


 




 
রুদ্রলাল, রুদ্রসবুজ, রুদ্রগেরুয়া



সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোলিং নিয়ে বেশ ওয়াকিবহাল রুদ্রনীল। তবে বিতর্কের মুখেও শান্ত থাকছেন। বলছেন, ‘যারা এই ট্রোলগুলো করছেন তাঁরা সিপিএম বা তৃণমূলের রাজনৈতিক কর্মী বা সমর্থক। নির্বাচনের আগে যে কোনও রাজনৈতিক দলই নিজেদের কাজের সপক্ষে প্রচার আর বিরোধী দলের বিরুদ্ধাচারণ করে থাকে। এটাই তো তাঁদের কাজ। আমি তৃণমূলের কোনও রাজনৈতিক পদে ছিলাম না। কেবল সরকারি কিছু দায়িত্ব সামলাতাম। অনেক তৃণমূল বিরোধী মানুষও সরকারি দায়িত্বে থাকেন। সরকার মানেই তৃণমূল নয়। তবে অনেকে যেমন বিরোধিতা করছেন, অনেকেই আমার বক্তব্যের সমর্থনও করছেন। ট্রোলিং-এ আমি বিচলিত হই না।‘ রুদ্রনীল যোগ করলেন, ‘যখন কেউ রুদ্রনীল, রুদ্রলাল, রুদ্রসবুজ, রুদ্রগেরুয়া বলেন, তাঁরা আসলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের হয়েই কথা বলেন। তাঁরা আসলে বলতে চান, বাংলা লাল, বাংলা সবুজ, বাংলা গেরুয়া। অনেকেই আমার বক্তব্যের সমর্থন করছেন, তবে তাঁরা প্রকাশ্যে সেটা বলতে পারেন না। করলে তাঁদের মারধর করার হুমকি দেওয়া হয়। তাঁরা আমার সোশ্যাল মিডিয়ার ইনবক্সে মেসেজ করেন।  রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মানেই শত্রু নয়। আমি ব্যক্তি আক্রমণে বিশ্বাস করি না। যাঁর যাকে মনে হবে তাকে সমর্থন করবেন। সবারই নিজের নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে।‘



 
 
বিজেপিই একমাত্র কঠিন প্রতিপক্ষ



সম্প্রতি তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদানের হিড়িক চলছে। রুদ্রনীলও ব্যতিক্রমী নন। গেরুয়া শিবিরে নাম লেখানো অভিনেতা বলছেন, ‘৩৪ বছর ধরে বাংলা লাল করত, তারাই সবুজ হল। ২০১৯ থেকে বাংলা অর্ধেক গেরুয়া হল, ২১-এ বাংলার পুরোটাই গেরুয়া হয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। শাসকদল মনে করছে বিজেপি তাদের একমাত্র কঠিন প্রতিপক্ষ। আজ যাঁরা তৃণমূল ছেড়ে বিজেপির পতাকার তলায় আসছেন, তাঁরা একদিন তৃণমূলের ওপরে ভরসা রেখেছিলেন। মানুষ বিজেপিকে বিশ্বাস করেছেন বলেই তো ২টো থেকে ১৮টা আসন হয়েছে। সাধারণ মানুষ চটঘেরা জায়গায় বোতাম টিপে নিজেদের মনোভাব ব্যক্ত করেন, আমি সেটাই প্রকাশ্যে বলছি।‘


 


[insta]

[/insta]



 
দুর্নীতির শাস্তি কান ধরে ওঠবোস!



রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আমফানের ত্রাণ নয়ছয় করা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি করার অভিযোগ তুলছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। কেন্দ্রের পাশে দাঁড়িয়ে রুদ্রনীল বলছেন, ‘সরকারি টাকা চুরির পরেও শাস্তি কান ধরে ওঠবোস! আমফানের পর যখন গরিব মানুষেরা সর্বহারা হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের ত্রিপল,চাল ডাল চুরি হয়েছে। দোষীদের কোনও শাস্তি হয়নি। সরকার থেকে একই পদে বহাল রাখা হয়েছে। সরকার গরিবের পাশে না দাঁড়িয়ে চোর বাটপাড়দের পাশে দাঁড়াচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীকেও বলতে হয়েছে আর কাটমানি নেবেন না। তৃণমূল বলছে স্বার্থের জন্য দলবদল করছে। তাহলে এত মানুষ নিজের ভোট বদলাচ্ছেন কেন!’


 




 
সাহস থাকলে প্রযোজকরা বলুন



টলিউডে রাজনৈতিক প্রভাব নিয়েও ক্ষুব্ধ অভিনেতা। রুদ্রনীল বলছেন, ‘বাম নেতাদের টলিউডে ইউনিয়ন ছিল। কিন্তু তাঁরা আরোপিতভাবে ভিন্ন মতের টেকনিশিয়ানদের বাধা দেননি বা সমর্থকদের আলাদা করে সুবিধা পাইয়ে দেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসার পর টালিগঞ্জকে সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর যাঁরা দায়িত্বে এলেন তাঁরা টালিগঞ্জকে নিজেদের সাম্রাজ্য ভাবতে শুরু করলেন। সেই সময় চন্দন সেন, কৌশিক সেন সহ অনেকেই কাজ পেতেন না। গিল্ড কার্ড লক করা হয়েছিল। টলিউডে একটা জুলুমবাজি চলছে। আমাদের টেকনিশিয়ান বন্ধুদের গিল্ড কার্ড নিয়েও রাজনীতি করা হয়েছে। শ্যুটিং ফ্লোরে যে যে বিভাগে কাজ নেই সেখানেও টেকনিশিয়ানদের নিতে বাধ্য করা হয়। টলিউডে বিভিন্ন ঘটনার জন্য বারবার নবান্নে বৈঠকে বসতে হয়েছে শিল্পীদের। কিন্তু যাদের ঘিরে রাজনীতিকরণের অভিযোগ, তাঁদের পদেই রেখে দিয়েছেন। এখন গিল্ড কার্ড পেতে গেলে তৃণমূলের রাজনৈতিক নেতাদের ঘনিষ্ঠ হতে হয়। সেটা না হলে নতুন প্রতিভাবান মানুষেরা গিল্ড কার্ড পান না। তৃণমূলের সভা হলে মঞ্চ আলোকিত করার জন্য শ্যুটিং ফ্লোর থেকে শিল্পীদের নিয়ে যাওয়া হয়। প্রযোজকরাও বাধ্য হন এই সহযোগিতা করতে। আমি নিজেও অনেকবার উপস্থিত হয়েছি। ২০১৬ সাল অবধি আমি তৃণমূলের পাশে দাঁড়িয়েছি, প্রচারে অংশগ্রহণ করেছি। আমি সেই সরকারকে সমর্থন করেছিলাম যেটা মানুষ বানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ২০১৬ সালে তৃণমূল ফের ক্ষমতায় আসার পর সবটা বদলে যায়। এখন কেউ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ মানেন না। তৃণমূল ঘনিষ্ঠ অনেকেরও শ্যুটিং বন্ধ হয়েছে। যদি প্রযোজকরা ভয় না পান তাহলে আমায় কথাগুলোই বলবেন। কারণ এইসব ঘটনা নিয়েই বারবার উত্তাল হয়েছে টালিগঞ্জ। সবাই সত্যিটা জানে। আমি সেটাই বলছি বলে প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে আমি মিথ্যে বলছি। টেকনিশিয়ানদের ভুল বোঝাচ্ছেন। যাঁরা এই কাজ করছেন তাঁদের মধ্যে অধিকাংশরাই আমার বন্ধু। আমার অভিনেতা বন্ধু সোহম বলেছেন আমায় ব্ল্যাকলিস্ট করা উচিত। ও ব্যক্তিগতভাবে জানে আমি সত্যি কখা বলছি। কিন্তু নির্বাচনের সম্মুখে তাঁর রাজনৈতিক পদ তাঁকে এই কথা বলতে বাধ্য করছে। এতে আমার আর সোহমের বন্ধুত্ব একটুও কমেনি।


 



 
 
রাজনীতিতে প্রসেনজিৎ!




সম্প্রতি ভিক্টোরিয়ায় নরেন্দ্র মোদির অনুষ্ঠানের দিন মঞ্চে দেখা গিয়েছিল প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে। যিনি এখনও কোনও রাজনৈতির শিবিরে নাম লেখাননি। রুদ্রনীল বলছেন, ‘ভিক্টোরিয়ায় অনেক নামিদামি মানুষজনই ছিলেন। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের মতো বড় নাম রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতেই পারেন। তবে কেউ আমার মতো দলে যোগ দিয়ে সদস্যপদ নিয়ে কাজ করেন, কেউ বা পিছন থেকে কাজ করেন। কে কোনটা করবেন এটা একান্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছা। নরেন্দ্র মোদি বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদটাকে তো সম্মান করতে হবে। এটাই সৌজন্য।’


 




 
সম্মান, দুবেলা দুমুঠো খাবার



রুদ্রনীলের দাবি, ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই বিজেপির প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন জানিয়েছেন কিন্তু কাজ চলে যাওয়ার ভয়ে মুখ খোলেন না। অভিনেতা বলছেন, ‘বাইরে তো বিজেপি করলে মারধর করা হচ্ছে, শাসানো হচ্ছে। এইভাবে আটকানো যাবে না। মানুষ ঠিক ভোটবাক্সে তাঁর মতপ্রকাশ করবেন। চাকরি চাইতে গেল এক যুবক, মইদুল। তাঁকে এমন মারা হল সে মারা গেল। এখন ভোটের আগে চাকরি দেওয়ার কথা বলছেন তাঁর পরিবারকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে নির্দেশিকা দেওয়ার ক্ষমতা অনেকদিন আগেই চলে গিয়েছে। এখন দল নিয়ন্ত্রণ করে অন্য কেউ। তাঁর কথা শুনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চলতে হয়। এখন দলের স্ট্র্য়াটেজি ঠিক করে দেয় অন্য কেউ। মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়ের হাতে সত্যিই ক্ষমতা থাকলে এই স্ট্র্য়াটেজিস্টের প্রয়োজন হল কেন? যা গন্ডগোল হয়েছে তা স্বীকার করার সততা দেখানো উচিত ছিল। দোষীদের শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল। সেইদিক থেকে মানুষের মুখ ফিরিয়ে নেওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে পরিবর্তন নতুন নয়। পরিবর্তনের মধ্যে দিয়েই দেশ এগিয়েছে। মানুষ শুধু একটু ভালো থাকতে চান। দুবেলা দুমুঠো খেতে চান আর একটু সম্মান চান।‘