কলকাতা: প্রয়াত নাট্যব্যক্তিত্ব স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। শোকের ছায়া নেমে এসেছে চলচ্চিত্র জগতে। চোখের জল বাধা মানছে না কলাকুশলীদের। একের পর এক নক্ষত্রপতন বাংলার শিল্প-সংষ্কৃতি জগতে। এই গত বছর। নভেম্বর মাসে চলে গেলেন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেদিন অসুস্থ শরীর নিয়েই এবিপি লাইভের সঙ্গে কতক্ষণ কথা বলেছিলেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। তাঁর কালজয়ী ছবির নায়ক যে তিনিই। যাঁর সঙ্গে 'ঘরে বাইরে' হয়ে 'বেলা শুরু' অবধি তাঁর যাত্রা। সেদিনের সেই সাক্ষাত্কারের কিছু অংশই আজ ফিরে লেখা।
৩০ বছর পার। সন্দীপ আর বিমলা সেদিন আবার মুখোমুখি, ফ্লোরে। চোখে চোখ। এবার আর সন্দীপ, বিমলাকেকে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে যেতে নয়। এবার তাদের দেখা বেলা শেষে। কিন্তু বিমলা এখনও ততটাই বিহ্বল। ‘আগের মতোই ওঁর মতো মহাতারকার দিকে তাকাতে মুগ্ধতাই আসে।’ বলছিলেন ‘ঘরে বাইরে’-র নায়িকা স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। সেইদিন স্মৃতিচারণায়। যখন, বিমলার সন্দীপ মহাশ্মশানের পথে।
সেই সময় স্মৃতিটুকুর পাতা ওল্টাচ্ছিলেন তিনি। তাঁর ‘বেলাশুরু’ থেকে 'বেলাশেষ' - এর সঙ্গী। সেদিন এবিপি লাইভকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে স্বাতীলেখা বলেছিলেন, '‘বড় সাধ ছিল, একসঙ্গে বসে ‘বেলাশুরু’ দেখব, হল না। এটা ভাবনারই অতীত।’' কিন্তু কী আশ্চর্য 'বেলাশুরু' মুক্তি পাওয়ার পর পর্দায় দেখা হল না সেই ছবির দুই স্তম্ভেরই। চলে গিয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। চলে গেলেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্তও। বাংলা চলচ্চিত্র জগতে হল যুগাবসান। পরলোকে পাড়ি দিলেন সত্যজিতের ছবির নায়ক-নায়িকা।
একসঙ্গে তো ছবি দেখাই হল না। 'বেলাশুরু' দেখতে পেলেন না সৌমিত্র-স্বাতীলেখা কেউই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পর একপ্রকার ভেঙেই পড়েছিলেন তিনি। পরপর দুটি ছবি এক সঙ্গে কাজ করার সৌজন্যে সম্পর্কটা আরও সুন্দর হয়ে উঠেছিল গত কয়েক বছরে। ২০২০ তে যেদিন তিনি চলে যান, তখনই বেশ অসুস্থ স্বাতীলেখাও। কাঁপা গলায় ধরা পড়ছিল অসুস্থতা। তারই মধ্যে স্মতি হাঁতরে একের পর এক গল্প করছিলেন তিনি। ‘এখনও মনে পড়ছে, শুটিংয়ে কত গল্প হত। কত স্মৃতিচারণা। অত বড় স্টার, কিন্তু খেতেন বাইরের খাবারই, বাড়ি থেকে খাবার আনতেন না। বলতেন, তুমি শুধু আমার খাবার সময়টা মনে করাবে। ওটা যেন মিস না হয়। খেতে বড্ড ভালবাসতেন।’ গলা কেঁপে আসছিল অভিনেত্রীর।
বলেছিলেন, ‘আমার সঙ্গে ওঁর প্রথম কাজ সবাই জানেন ঘরে-বাইরে। মানিকদার পরিচালনা। আমি তো নতুন। সঙ্গে ভিক্টর, সৌমিত্র। আমি ওঁদের কাজ, আত্মবিশ্বাস, ভঙ্গিমা হাঁ করে দেখতাম। যতদূর মনে পড়ে, বিমলা দরজার বাইরে পা রেখে দেখছে সন্দীপকে। সেটাই শ্যুট করা প্রথম দৃশ্য। তারপর প্রতিটা শট আরও-আরও সফল হয়েছে সৌমিত্রর কোঅপারেশনে।’ স্মৃতি যেন ছবির মতো ভাসছিল সত্যজিতের নায়িকার চোখে।
‘কিন্তু জানো, আমার কোনও অসুবিধা হয়নি। ৭-৮ বার টেক দিতে হয়েছিল। বারবার সৌমিত্রর শালে আমার হাত চাপা পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ওই দৃশ্যে শাঁখা পলা দেখানোটা খুব দরকার ছিল, অর্থাৎ এয়ো-স্ত্রী র চিহ্ন। সৌমিত্রবাবু এত সহজ করে দিলেন বিষয়টি, নবাগতা আমি কত সহজেই করে ফেললাম বিষয়টি। এখনও মনে পড়ে।’ স্মৃতিতে ডুবে গেলেন তিনি।
‘আমার শরীরটা এখন মাঝেমধ্যে খারাপ হয় হাসপাতালে ভর্তিও হতে হয়েছে। কিন্তু সৌমিত্রবাবু সেই ক্ষিদ্দা স্টাইলে বলতেন, হারলে হবে না স্বাতীলেখা। মনটা শক্ত রাখতে হবে। কাজ করতে হবে। সৌমিত্রবাবুই আসল ক্ষিদ্দা,’ স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন নায়িকা। সত্যিই অসুখের সঙ্গে বীরাঙ্গনার মতোই লড়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যু তো অনিবার্য ! সেখানে হার-জিত হয় না।
আজ, বুধবার হাসপাতালেই প্রয়াত হন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। বিগত ২৫ দিন ধরে শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। আজ দুপুরে হাসপাতালেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। দীর্ঘদিন ধরেই কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন স্বাতীলেখা। হাসপাতাল সূত্রে খবর, এদিন কিডনি বিকল হয়ে মৃত্যু হয়েছে তাঁর।