কলকাতা: প্রত্যেক ছবির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হচ্ছে সঙ্গীত (Music)। বিশেষত যে কোনও ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে তৈরি সিনেমায় আবহ সঙ্গীত (Background Music) বড় ভূমিকা পালন করে। কোনও দৃশ্যের গুরুত্ব বা মানে বদলে দিতে পারে নিখুঁত সঙ্গীত। ২৬ জানুয়ারি মুক্তি পাচ্ছে বহু প্রতীক্ষিত '৮/১২'। বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্তের বীরগাঁথা নিয়ে তৈরি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব সামলেছেন সৌম্য ঋত (Soumya Rit)। কাজের মাঝে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন এবিপি লাইভকে (ABP Live)।


প্রশ্ন: '৮/১২' ছবির গান বেশ সাড়া ফেলেছে শ্রোতামহলে। প্রথম যখন এমন একটা ছবির কাজ আসে, কী মনে হয়েছিল?
সৌম্য ঋত: কাজটা খুবই অপ্রত্যাশিতভাবে আসে। ছবিটা প্রথম থেকে আমার ছিল না। শ্যুটিংয়ে তিন-চারদিন আগে একটা নির্দিষ্ট গান লেখার প্রস্তাব আসে। অরিজিৎ সিংহের গাওয়া 'স্বাধীন হবে দেশ' গানটি লেখার প্রস্তাব দেন অরুণ দা (অরুণ রায়)। দেশ রাগের ওপর এই গানটি তৈরি করে পাঠাই আমি। এটাই ছবির প্রথম তৈরি হওয়া গান। গানটি ভাল লাগায় এরপর প্রযোজক কান সিং সোধার কাছ থেকে গোটা ছবির সব গান ও আবহ সঙ্গীত তৈরির প্রস্তাব আসে। কান সিং সোধার হয়ে এর আগেও আমি কাজ করেছি। এরপর রূপম ইসলামের গাওয়া গানটি তৈরি হয় যদিও সেটা আগে মুক্তি পায়। কাজটার জন্য আমার পরিচালক ও প্রযোজক, দুই জনের কাছেই আমি চিরকৃতজ্ঞ। দেশের জন্য গান লেখার এই সুযোগটা করে দেওয়ার জন্য ওঁদের ধন্যবাদ। 


প্রশ্ন: ওই নির্দিষ্ট সময়টাকে গানের মাধ্যমে তুলে ধরার সময় কোন কোন জিনিস মাথায় রাখতে হয়েছিল?
সৌম্য ঋত: 'মা তোর ছেলেরা ঘর ছেড়েছে...' এটা আমি লিখিনি, এটা ঈশ্বর আমাকে দিয়ে লিখিয়েছেন। সকালবেলা বসেছি লিরিক্সটা জাস্ট বেরিয়ে গেছে। প্রেক্ষাপট অরুণ দা বলে দিয়েছিলেন। আমার দেশের গান লেখার ইচ্ছে বহুদিনের। এমনকী তার কিছুদিন আগেই স্ত্রীকে বলছিলাম যে আমার কাছে দেশাত্মবোধক সিনেমার কোনও কাজ কেন আসে না, আমার ভীষণ ইচ্ছে। তার পরপরই এই কাজটা এসেছে। বিনয়-বাদল-দীনেশের গল্প তো আমরা ছোট থেকেই সকলে শুনেছি। ফলে এমনিই মনের মধ্যে তখনকার সময়ের একটা কালার-টোন মাথায় থাকেই। তবে বিশেষ সময়ের প্রেক্ষাপটে তৈরি ছবি বলে 'পিরিওডিক' বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেছি এমনটা নয়। আমি অরুণ দার সঙ্গে কথা বলেই নিয়েছিলাম। সেই কারণেই রূপম দার গানটা পুরোপুরি হার্ড রক সঙ্গীত। গোটা ছবির নেপথ্য সঙ্গীতেও বহু রক সঙ্গীতের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে যেহেতু সঙ্গীতের ক্ষেত্রে 'রক' বিপ্লব এনেছিল। ফলে বাংলার প্রেক্ষাপটে ৬০-৭০ বছর আগের গল্প দেখানো হচ্ছে মানেই যে সানাই বা বাঁশি বাজবে, সেই জিনিসটা হয়নি।


প্রশ্ন: তাহলে এই ছবির জন্য কাজ আপনার 'স্বপ্নপূরণ' বলা যেতে পারে?
সৌম্য ঋত: হ্যাঁ। সেটা বটেই। বহুদিন থেকে ইচ্ছে ছিল দেশাত্মবোধক বা আধ্যাত্মিক গান নিয়ে করব। যেহেতু আমি রামকৃষ্ণ মিশনের ছেলে। আমার বাড়িতে কাকারা সন্ন্যাস নেওয়া। আমার বাবা রবীন্দ্রভারতীর 'ফ্যাকাল্টি অফ ফাইন আর্টস'-এর বর্তমান ডিন। আমার মধ্যে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত যেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে আছে, আর তার অবদান আমার বাবার। আমার যেকোনও সুরেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ছোঁয়া থাকে। রাগের ছোঁয়া থাকে। 


প্রশ্ন: নিজের মধ্যে কখনও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও রক সঙ্গীতের বিভেদ তৈরি হয় না?
সৌম্য ঋত: না। আমার বাড়ি তো গানের জায়গা পুরো। আমার মা রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী, বাবা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গুরু। ফলে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতটা আমি নিয়েই জন্মেছি। ছোটবেলায় যদিও আমাকে জোর করেও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শেখানো যায়নি। প্রত্যেক দিন যে বাদ্যযন্ত্রগুলো বাড়িতে দেখতাম যেমন হারমোনিয়াম, তবলা, তানপুরা, সেগুলো তখন আকর্ষণীয় লাগত না। তখন স্কুলে গিয়ে গিটার, পিয়ানো আকর্ষণ করত বেশি। ফলে নিজের গানবাজনা, ব্যান্ড করা শুরু করি, তখন রক সঙ্গীত করতাম। নিজেই লিখতাম, সুর করতাম। ২০১৩ সালে কলেজের পর ব্যান্ড ভাঙে। তারপর রবীন্দ্রভারতীতে ক্লাসিক্যাল মিউজিক নিয়ে পড়াশোনা করতে ভর্তি হই। ফলে বিভেদের প্রশ্নই নেই। আমি সমস্ত ধরনের সঙ্গীত নিয়েই কাজ করতে চাই। আমার বিভিন্ন কাজে বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীতের ব্যবহার করেছি। ফলে এই ওয়ার্ল্ড মিউজিক, রক মিউজিক, ক্লাসিক্যাল, পুরোটাই আমি যাপন করেছি নিজে।


প্রশ্ন: অরিজিৎ সিংহের সঙ্গে প্রথম কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
সৌম্য ঋত: (হেসে) স্বপ্নের মতো। সম্ভব যদিও হয়েছে অরুণ দার জন্য। ওঁর প্রতি অরিজিতের একটা আলাদা ভালবাসা, শ্রদ্ধা আছে। 'এগারো' ছবিতে অরিজিৎ সিংহ গান গেয়েছেন। এই ছবিরও মূল গান অরিজিতের গাওয়া। আমি প্রথম থেকেই শুনেছিলাম যে ওঁর ভাল লেগেছে গান, গাইতেও রাজি। নভেম্বরের শেষে আমার কাছে হঠাৎ একটা ফোন আসে। ওপারে অরিজিৎ সিংহ। ফোন ধরে বলেন, 'তোমার গানটা দারুণ হয়েছে। আমি গানটা গাইব।' এরপর আলোচনা হয়। গান গেয়ে পাঠান অরিজিৎ। শুধু বলছি, যেটা পাঠালেন সেখানে কারেকশনের তো কোনও জায়গা ছিলই না। আমি এখনও বলি, যে কোনও ব্রিফ ছাড়া, একেবারে যেখানে যেমন বলেছি সেখানে সেভাবেই কেউ কীভাবে গাইতে পারেন। তবে গানের মধ্যের এবং শেষের আলাপ দুটো আমার গলাতেই রয়েছে। সেটা অরিজিৎ সিংহের কথাতেই রাখা হয়েছে। অরিজিৎ বলেন, 'ওটা ঋতের গলাতেই থাক, ভীষণ ভাল ফিল রয়েছে।' ফলে প্রথম আলাপটা অরিজিতের কণ্ঠে। তাছাড়া প্রত্যেকটা আলাপই আমার গাওয়া।


প্রশ্ন: গোটা অ্যালবামে আপনার পছন্দের গান কোনটা?
সৌম্য ঋত: 'স্বাধীন হবে দেশ'। প্রথমত আমি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ভালবাসি। দেশ রাগের ওপর তৈরি গান। এই গানটি যতবার আমি নিজে গাই, আমার চোখ ভিজে যায়। এবং যে সময়ের প্রেক্ষাপটে তৈরি ছবি আমি সেই ভাষায় লিখিওনি। আমরা সাধারণত যে ভাষায় কথা বলি তেমনই সহজ সরল বাক্য ব্যবহার করেছি। বাকি গানগুলিও অবশ্যই পছন্দের।


আরও পড়ুন: Remoo Exclusive: দীনেশ গুপ্তর বাড়ির লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করি, খুব সাহায্য করেছেন: রেমো


প্রশ্ন: এরপর কী কী কাজ আছে?
সৌম্য ঋত: হাতে তো বেশ কিছু কাজ রয়েছে। তবে নিশ্চিত না হলে বলতে পারছি না। কিছু অসমাপ্ত কাজ রয়েছে নিজের। সেগুলোও শেষ করে ফেলব ধীরে ধীরে।