কলকাতা: দেখতে দেখতে আরও একটা বছর শেষের মুখে। হাজির ২৫ ডিসেম্বর। বড়দিন (Christmas Day)। করোনার ধাক্কা খানিক সামলে শহর কলকাতা ফের সেজে উঠেছে রঙিন আলোয়। জমিয়ে ঠান্ডা, গরম জামা, সান্তা ক্লজ, ক্যারল, কেক, ওয়াইন, উপহার থেকে শুরু করে পার্ক স্ট্রিট, বো ব্যারাক, সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল। বড়দিনে এইগুলো বাঙালির কাছে বেশ পরিচিত। আর বাঙালি সিনেমা প্রেমীদের কাছে বড়দিনের সঙ্গে যেন একাত্ম হয়ে হাজির হন অঞ্জন দত্ত (Anjan Dutt)। ক্রিসমাস যাঁর কাছে খুবই স্পেশাল। বিশেষত 'ক্রিসমাস ইভ' (Christmas Eve) অর্থাৎ ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে শুরু করে রাত ১২টার 'মিডনাইট মাস' (Midnight Mass)। কেমন কাটে তাঁর বড়দিন? এবিপি লাইভকে একান্ত সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত জানালেন।


বড়দিন অঞ্জন দত্তের কাছে দুর্গাপুজোর থেকেও খানিক বেশিই স্পেশাল। একই পাড়ায় প্রচুর পার্সি, আর্মেনিয়ান, অ্যাঙ্গলো ইন্ডিয়ান, খ্রিষ্টান পরিবারের সঙ্গে বেড়ে ওঠার প্রভাব তো রয়েইছে। এছাড়া তাঁর কথায়, 'দাদুর আমল থেকেই ক্রিসমাস ইভে আমাদের বাড়িতে গেট টুগেদার হয়ে আসছে। সেখানে কাউকে আলাদা করে নিমন্ত্রণ করার প্রয়োজন পড়ে না। যাঁরা জানেন তাঁরা নিজেরাই চলে আসেন। আমাদের চিরকালই ক্রিসমাস ইভ অর্থাৎ ২৪ তারিখ বড় করে সেলিব্রেট হয়। ওই দিনটা বেশি স্পেশাল।'


বড়দিন বা নিউ ইয়ারে ভিড় উপচে পড়ে পার্কস্ট্রিটের বিখ্যাত রেস্তোরাঁগুলিতে। কিন্তু পার্কস্ট্রিট পছন্দের জায়গা হলেও বড়দিনের খাওয়া দাওয়া বাড়িতেই সারে দত্ত পরিবার, একসঙ্গে। 'বাড়িতেই লাঞ্চ বা ডিনারে টার্কি হয়। একসঙ্গে খাওয়া হয়। কোথাও গিয়ে বড়দিন উদযাপন আমরা করি না। ব্রিটিশ অ্যাঙ্গলো ইন্ডিয়ানসদের সঙ্গে থাকতে থাকতে ওঁদের মতোই ক্রিসমাসটা বাড়িতে সেলিব্রেট করার অভ্যেসটাই চলে এসেছে ছোটবেলা থেকে।'


আরও পড়ুন: Christmas 2021 : কেকের উষ্ণতায় উৎসবমুখর বেকারি, ক্রিসমাস সুদিন ফেরাবে কি


ক্রিসমাস মানেই কেক মাস্ট। বাড়িতে কেক বানান অঞ্জন দত্ত? 'আমার স্ত্রী (ছন্দা দত্ত) কেক তৈরি করেন। নীল (নীল দত্ত)-এর বিয়ের পর ওঁর স্ত্রীও ক্রিসমাসে কেক বানান। 'নাহুমস' থেকে একটা কেক আসেই, সেটা নিশ্চিতভাবে আসে। আর সঙ্গে টার্কি তো রান্না হয়ই।'


অঞ্জন দত্ত মানে একাধারে গায়ক-পরিচালক-অভিনেতা সবই। তাঁর ব্যান্ডও আছে। নিয়মিত অনুষ্ঠান করেন তাঁরা। বড়দিনে শো করেন? 'না, ক্রিসমাসের সময় আমরা শো করিনি। বলা ভাল ওই সময়ে আমরা অনুষ্ঠান করি না। ২৪ ডিসেম্বরে বাড়িতে আমাদের গেট টুগেদারটা হয়ই। ওটা কখনও বন্ধ হয় না। দু'বছর আমি ছিলাম না, একবার লন্ডন আর একবার ইতালি গিয়েছিলাম। তখন নীল ওই পার্টিটা চালিয়ে গেছে। নীল না থাকলে আমি চালাই। কারণ আমরা জানি মানুষ আসবেনই। আমি তাঁদের আটকাতে চাই না। অনেকেই সকাল থেকে ফোন করেন। জিজ্ঞেস করেন যে শুনেছি আপনার বাড়িতে এরকম হয়, আমরা আসতে পারি কি? তাঁদেরকে ডেকে নিই। অনেকে নিজেদের বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে আসেন। নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়। অনেকের সঙ্গে সারা বছর দেখা হয় না কিন্তু এই দিনে তাঁরা চলে আসেন ঠিক।'


বড়দিনের বিশেষ কোনও মুহূর্ত মনে পড়ে? প্রশ্ন শুনে খানিক ভেবে পরিচালকের উত্তর, 'ক্রিসমাস সবসময়েই খুব আনন্দে কেটেছে। এক-দু বছর ভারতের বাইরে কাটিয়েছি। একবার বড়দিন পালন করতে গিয়েছিলাম ইতালিতে। ভ্যাটিকানে বড়দিন পালন করেছিলাম সেইবার ছন্দার সঙ্গে। সিস্টিন চ্যাপেল দেখা, ভ্যাটিকানে বড়দিন পালন করা, সেখানে চার্চে সময় কাটানো, ওটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা স্মৃতি। ওখানে তো অজস্র গির্জা। আমার খুব ইচ্ছে ছিল ভ্যাটিকানের ভিতরে ক্রিসমাস দেখার। সেখানে পোপ কী কী করেন সেটা দেখা, ওঁদের 'মিডনাইট মাস'টা করার ইচ্ছে ছিল। সেটা আমি করতে পেরেছি।'


বড়দিন মানেই তো বাঙালির পার্কস্ট্রিট যাওয়ার একটা চল আছে। সেই তালিকায় কি অঞ্জন দত্তেরও নাম আসে? 'আমি যখন ছোট ছিলাম, পার্কস্ট্রিটে ক্রিসমাসের তখন অন্য মজা ছিল। রাত ১২টার সময়ে ওখানে সকলে একত্রিত হতেন। নিয়ম করে যাওয়া হত। অজস্র মানুষ আসতেন পার্কস্ট্রিটে একে অপরকে 'মেরি ক্রিসমাস' জানাতে। প্রত্যেকটা রেস্তোরাঁ থেকে সকলে বেরিয়ে আসতেন রাস্তায়, কেউ কাউকে চেনেন না, কিন্তু শুভেচ্ছা জানাতেন। তখন তো রেস্তোরাঁয় খেতে যেতাম না কিন্তু গাড়ি করে রাত ১২টায় পার্কস্ট্রিটে নিয়ে যাওয়া হত। এখন সেই প্রথাটা নেই আর। কিন্তু বড়দিনে পার্কস্ট্রিট সাজানোর নিয়ম এখনও চলছে। এই ট্রেডিশনটা আমার কাছে খুব প্রয়োজনীয়। এখন একটা মেলা মতো হয়। সেখানে দু-তিন বছর গেছিও সকালের দিকে। আমার কাছে এটা খুব ভাল লাগার এবং খুব জরুরী একটা প্রথা।'


অঞ্জন দত্তের বিখ্যাত সিনেমা 'বো ব্যারাকস ফরএভার'। কলকাতার বুকের বো ব্যারাকে সত্যিই সিনেমার মতো করেই বড়দিন উদযাপিত হয়। তাঁর মতে, কলকাতা বিভিন্ন সংস্কৃতির মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা একটি শহর। 'কলকাতার এই ঐতিহ্য বা ইতিহাসটাকে ধরে রাখতে পারলে ভাল হয়। এটা নিশ্চিত করা প্রয়োজনীয় যে কলকাতা কোনও একটা উৎসব নয়, বরং পুজো, ইদ, বড়দিন সবকিছুতে মেতে উঠবে। সেটাই আমাদের ইতিহাস।'